সন্ত্রাসের ধর্ম

কূট প্রশ্ন উত্থাপন করা সম্ভব— ‘শ্বেত-সন্ত্রাস’ বলিব কেন? কেবল ‘সন্ত্রাস’ বলিতে সঙ্কট কোথায়?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০১৯ ০০:১৬
Share:

ছিল ‘বন্দুকবাজ’, হইয়া গেল ‘জঙ্গি’। নিউজ়িল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতেই রাতারাতি বয়ান বদলাইয়া ফেলিল পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের একাংশ। প্রথমে পাকিস্তানি তরুণী মরিয়ন মহসিন পুরাতন সংবাদ শিরোনাম দেখাইয়া টুইটারে চিহ্নিত করিয়াছিলেন, শার্লি এবদোর দফতরে হামলাকে জঙ্গি হানা বলা হইলেও ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলার ঘটনাটি স‌ংবাদ শিরোনামে বন্দুকবাজের হানা। প্রশ্ন উঠিয়াছিল, উভয় ক্ষেত্রেই ঘাতক নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করিলেও হামলাকারীর তকমায় বৈষম্যের কারণ কী? কেহ বলিয়াছেন, আক্রমণের প্রকারভেদ আছে। কাহাকেও সন্ত্রাসবাদী বলিলে হিসাব কষিতে হয়, ব্যক্তি বৃহত্তর কোনও জালের অন্তর্ভুক্ত কি না। কোনও গোষ্ঠীর পরিকল্পনা বা বৃহৎ আদর্শে পরিচালিত কি না। এই বার এক ধাপ আগাইয়া উল্লেখ করা যায়, ‘বন্দুকবাজ’ অস্ট্রেলীয় যুবক ব্রেন্ডন ট্যারান্ট হামলার চালাইবার পূর্বে ইস্তাহার প্রকাশ করিয়া মুসলমান ও বহিরাগতদের প্রতি বিপুল বিদ্বেষের উদ্গার ঘটাইয়াছল। অতএব, ‘বন্দুকবাজের হামলা’ পরিণত হইয়াছে ‘শ্বেত-সন্ত্রাস’-এ। সর্বাধিক জরুরি দায়িত্বটি অবশ্য পালন করিয়াছেন নিউজ়িল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আর্ডের্ন। তিনি বলিয়াছেন, “নিঃসন্দেহে ইহা জঙ্গি হামলা।”

Advertisement

কূট প্রশ্ন উত্থাপন করা সম্ভব— ‘শ্বেত-সন্ত্রাস’ বলিব কেন? কেবল ‘সন্ত্রাস’ বলিতে সঙ্কট কোথায়? বস্তুত, ‘জঙ্গি’র সর্বাধিক পরিচিত চিত্রটি ইসলামি সন্ত্রাসবাদের সূত্রেই গ্রথিত। ইসলাম ধর্মাবলম্বী কোনও ব্যক্তি হামলা চালাইলে নির্দ্বিধায় জঙ্গি বলিয়া থাকে পশ্চিমি দুনিয়া। যেন সন্ত্রাস হইলেই ইসলামি হইবে, ভাবনাটি স্বতঃসিদ্ধ। ‘সন্ত্রাস’-এর পূর্বে ‘শ্বেত’ বিশেষণটি সেই যুক্তিকেই জোরদার করে। কারণ, এখনও অবধি অপর কোনও সন্ত্রাসে ‘ইসলামি’, ‘কৃষ্ণাঙ্গ’, ‘বাদামি’ প্রভৃতি বিশেষণের প্রয়োগ দেখা যায় নাই। উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ করা সম্ভব। ভারতে গোরক্ষাকারীরা কাহাকেও হত্যা করিলে উহাদের ‘হিন্দু তালিবান’ বলা হইয়া থাকে। আফগানিস্তানের সন্ত্রাসবাদীদের ‘মুসলমান গোবাহিনী’ বলা হয় না। পরিচিত যুক্তিটি হইল, নির্দিষ্ট ধর্মের জিগির তুলিয়া অপর ধর্মের মানুষকে আক্রমণ করা হইতেছে। ২০১৬-এ অরল্যান্ডোর নাইটক্লাবে ৫০ জনকে খুনের নৃশংসতা স্মরণ করাইয়া বলিতে হয়, প্রতিটি সন্ত্রাসেরই অাতসকাচের তলে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার হউক। ইসলামি হইলে জঙ্গি, আর ত্বকের বর্ণ শ্বেত হইলে ব্যক্তি বিকৃতমনস্ক সমাজবিচ্ছিন্ন, ইহা হইতে পারে না। একই চিত্রনাট্যের পুনরভিনয় এই যুক্তিকে খণ্ডন করিবে।

সুতরাং, জোর গলায় বলিতে হইবে: সন্ত্রাসের ধর্ম হয় না। কিংবা সব ধর্মের নামেই হয়। ত্বকের রং, জাতি, লিঙ্গপরিচয়, ধর্মবিশ্বাস— এই সব জিগির তুলিয়া খুনের উৎস এক এবং একমাত্র ঘৃণা। এবং তাহা সমাজের একাংশের ভিতরে ছড়াইয়া থাকে। এই রোগ একক নহে, গোষ্ঠীগত। মানবসভ্যতার পক্ষে সর্বাধিক বিপজ্জনক অবয়বেই এই ঘৃণার নকশা প্রস্তুত করা হইতে থাকে। দীর্ঘ দিন ধরিয়া ক্ষেত্র তৈরি হয়, জমি কর্ষণ হয়, উহা ফলবান হয়। সেই ফসল নির্বাক দর্শকের ন্যায় দেখিতে হয় জনতাকে। কিংবা প্রাণ খোয়াইতে হয়। সুতরাং, স্মরণে রাখা ভাল, ঘৃণা কেবল নয়-এগারোর জন্ম দেয় নাই, তাহার বহু পূর্বে হলোকস্টেরও জন্ম দিয়াছিল। সব সন্ত্রাসকে একই বন্ধনীতে আলোচ্য করিয়া তুলিতে না পারিলে যথার্থ সমাধান অসম্ভব। প্যারিসে জঙ্গি হামলার পরে ফেসবুকে কালো ছবি পোস্ট করিলে, নিউজ়িল্যান্ডের পরেও করা উচিত। ইসলামি সন্ত্রাসের নিন্দা করিতে করিতে দক্ষিণপন্থী হিংসার কথাও বিস্মৃত হইলে চলিবে না। সকল সন্ত্রাসবাদ সমরূপে নিন্দিত হয় না, ইহা কটু সত্য। তবে যদি বুঝা যায় যে সকল সন্ত্রাসই বস্তুত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার অহংজনিত হিংসা— তাহা হইলে হয়তো সংবাদ শিরোনামের ধরন পরিবর্তিত হইতেও পারে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন