প্রতীকী ছবি।
প্রশ্নগুলো আবার তুলতে হচ্ছে। খেলার মাঠ নিয়ে এবং খেলোয়াড়দের নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক কী রকম? এই প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট হয়ে যাওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক ক্রীড়া মানচিত্রে ভারতের অবস্থান ক্রমে উজ্জ্বল হোক— এমনটা দেশবাসী তো চানই, দেশের সরকারও অবশ্যই চায়। কিন্তু সেই ঔজ্জ্বল্যে কোন পথ ধরে পৌঁছতে চাই আমরা? মহাসমারোহে, বিপুল জাঁকজমকে ফুটবলের যুব বিশ্বকাপ আয়োজন করলেই কি কাঙ্খিত ঔজ্জ্বল্যে পৌঁছনো যাবে বলে আমরা মনে করছি? নাকি এও বুঝছি যে, আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠা জরুরি? আমরা বুঝি বা না বুঝি, দ্বিতীয় পথটিই যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, সে এক চিরন্তন সত্য। তাই ক্রীড়া আয়োজক হিসেবে বিশ্বের সামনে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলার পাশাপাশি, দেশের খেলোয়াড়দের যত্ন নেওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি, খেলার মাঠের ভবিষ্যৎ প্রজন্মটাকে শানিত করে তোলা জরুরি।
আরও পড়ুন: মেঝেয় শুয়ে অ্যাথলিটরা, তীব্র ক্ষোভে বললেন, এটাই কি আমাদের প্রাপ্য?
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে গোটা দেশ দেখল, জাতীয় মিট থেকে ফেরার পথে দিল্লির অ্যাথলিটরা ট্রেনে সংরক্ষিত আসনটুকুও পেলেন না। কেউ মেঝেয় বসে, কেউ শৌচাগারের সামনে শুয়ে, কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে। ট্রেন থেকে নেমে অসুস্থও হয়ে পড়লেন কেউ কেউ।
ক্রিকেট বা হকিতে ভারতের স্থান আন্তর্জাতিক মঞ্চে যে রকম গৌরবান্বিত, সেই পর্যায়ের গৌরবের সাক্ষী আরও কয়েকটি খেলার আসরে ভারত হয়েছে। কিন্তু সে গৌরবের নেপথ্যে সরকারি বা সমষ্টিগত কৃতিত্ব যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি রয়েছে ব্যক্তিগত কৃতিত্ব। আন্তর্জাতিক মঞ্চে সামগ্রিক ভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে গেলে এখনও অনেক অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে ভারতকে। পাড়ি যে দিতে হবে, সে গোটা দেশ জানে। আমাদের ক্রীড়া সংগঠক এবং ক্রীড়া প্রশাসকরাও অবশ্যই জানেন। কঠিন লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলে খেলোয়াড়দের তাঁরা উৎসাহিত করেন। কিন্তু কথায় যাই বলুন, তাঁদের কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়ার মতো কোনও রসদ মেলে না।
জাতীয় মিট থেকে ফেরার পর তরুণ খেলোয়াড়রা প্রশ্ন করছেন, এই কি তাঁদের প্রাপ্য? খুব প্রাসঙ্গিক এবং জরুরি প্রশ্ন। খেলাধুলো করে প্রাপ্য যদি এই হয়, সম্মানের নমুনা যদি এমন হয়, তা হলে ছেলেমেয়েরা খেলায় উৎসাহ পাবেন কী ভাবে? এ কথা ঠিক যে, কোনও বিষয়ে প্রতিভার উন্মেষ কখনও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানির কারণে ঘটে না। কিন্তু প্রতিভার বিকাশের জন্য ন্যূনতম পরিবেশ তৈরি রাখা যে অত্যন্ত জরুরি, তা অস্বীকার করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। এত অযত্ন, অবহেলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার মাঝে প্রতিভার বিকাশই বা হবে কী ভাবে।
ঘটনাটি কিন্তু প্রথমবার ঘটল না। এর আগেও খেলোয়াড়দের একইভাবে অপদস্থ বা হেনস্থা হতে হয়েছে। এ দিনের ঘটনাটির মধ্যেও সেই অকারণ অব্যবস্থারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ কিন্তু খুব কম নয় আজ। সেই বিপুল বরাদ্দের প্রতিফলন দেশের ক্রীড়া পরিকাঠামোয় দেখা যায় না। খেলোয়াড়দের জীবনের উল্লেখযোগ্য মানোন্নয়নও চোখে পড়ে না। এই ধারা বহাল থাকলে উন্নতির আশা বড়ই কম। বহিরঙ্গে চাকচিক্য বাড়বে, আইপিএল হবে, আইএসএল হবে, বিপুল অঙ্কের ক্রীড়া-বাণিজ্য হবে। মাঝে-মধ্যে দু’একটা আন্তর্জাতিক আসর আয়োজনের সুযোগও চলে আসবে। অভূতপূর্ব জাঁকজমকে সে সব আমরা উতরে দেব, বিদেশিদের প্রশংসা কুড়িয়ে গদগদ হব। কিন্তু যাবতীয় চাকচিক্য বহিরঙ্গেই রয়ে যাবে। ভিতরে সেই জীর্ণ, ক্লিন্ন, মলিন বাস্তবতাটাই থেকে যাবে।
দেশকে পরিচ্ছন্ন করে তুলতে বিরাট অভিযানে নেমেছে ভারত সরকার। বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। রথী-মহারথীরা ঝাড়ু হাতে সাফাই অভিযানে নামছেন। এই অভিযানের জেরে বহিরঙ্গে কিছু পরিচ্ছন্নতার ছাপ ফুটে উঠছে বটে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিজেদের স্বভাব আমরা কতটুকু বদলাতে পারছি, তা আমাদের চেয়ে ভাল কেউ জানেন না। আনুষ্ঠানিকতা ছেড়ে যে দিন খেলাধুলোর প্রকৃত উন্নয়নের কথা ভাবতে শুরু করব আমরা, সেই দিন থেকে বদলের সূচনা হতে পারে। তার আগে এ দেশের খেলাধুলোর মুক্তি নেই জাঁকজমক ব্যবসায়ীদের হাত থেকে।