প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘উজ্জ্বলা’ প্রকল্প কি স্তিমিত হইল? ২০১৬ সালে সূচিত এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল পাঁচ কোটি দরিদ্র পরিবারে রান্নার গ্যাসের সংযোগ। সংযোগ বাড়িয়াছে সত্য। কিন্তু দাম যত বাড়িয়াছে, ততই কমিয়াছে চাহিদা। এক সঙ্গে নয়শত টাকা বার করিবার ক্ষমতা দরিদ্রের নাই। যথাকালে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ভর্তুকির টাকা ঢুকিবে, সেই ভরসা থাকিলেও এককালীন অত নগদ জুটিবে কী করিয়া? দরিদ্রের এই সঙ্কটের সম্ভাবনা কেন পূর্বেই আন্দাজ করা হয় নাই, বুঝা কঠিন। রান্নার গ্যাসের দাম বাজারের সহিত ওঠাপ়ড়া করিবে, এই সিদ্ধান্তের সঙ্গেই তাহা দরিদ্রের নাগালের বাহিরে যাইবার সম্ভাবনাও সূচিত হইয়াছিল। তর্কের খাতিরে ধরা যাইতে পারে, এই সঙ্কট আন্দাজ করা কঠিন ছিল। কিন্তু গ্যাস সুলভ করিবার নানা উপায় ছিল। সরকার ‘উজ্জ্বলা’ প্রকল্পের গ্রাহকদের ভর্তুকি পরে অ্যাকাউন্টে না পাঠাইয়া বিক্রয়ের সময়ে ভর্তুকি-সমন্বিত দামে দিতে পারিত। ইচ্ছুক গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হইতে কিস্তিতে টাকা নেওয়ার সুযোগও হয়তো করা যাইত। কিন্তু দাম মিটাইবার পথ সহজ না করিয়া, ছোট সিলিন্ডারের বিপণন বাড়াইতে চাহে সরকার। যুক্তি, চৌদ্দ কিলোগ্রামের পরিবর্তে পাঁচ কিলোগ্রামের সিলিন্ডার দরিদ্রের নিকট সুলভ হইবে। একটি গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থার আধিকারিক বলিয়াছেন, দরিদ্রের চাহিদা কম, তাই ক্ষুদ্র সিলিন্ডারই যথেষ্ট।
চাহিদা কম কেন? দরিদ্র পরিবারে জ্বালানির প্রয়োজন কম নহে। তৎসত্ত্বেও উজ্জ্বলা প্রকল্পাধীন অর্ধেক পরিবার বৎসরে চারিটি সিলিন্ডারও কেনে নাই। বহু গ্রাহক গ্যাস সংযোগের পর দ্বিতীয় সিলিন্ডার কেনেন নাই। তাহার অর্থ, তাঁহারা জ্বালানির প্রয়োজন এখনও মুখ্যত কাঠকুটো কয়লা প্রভৃতি দিয়া মিটাইতেছেন। ইহা মানিলে বুঝিতে হইবে, দরিদ্র মহিলাদের দূষণমুক্ত রন্ধন নিশ্চিত করিবার যে অঙ্গীকার সরকার করিয়াছিল, উজ্জ্বলা প্রকল্প তাহা পূরণ করিতে পারে নাই। গ্রাম হইতে প্রাপ্ত তথ্যও তাহাই বলে। পাটকাঠি, ঘুঁটে প্রভৃতি দূষণকারী হইলেও সুলভ। বর্জ্য হইতে জ্বালানি প্রস্তুতিতে মেয়েদের অনেকটা সময় ব্যয় হয়, ব্যবহার করিলে স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হয়। কিন্তু পরিবারের সাশ্রয় অপেক্ষা নারীর স্বাস্থ্যের সুরক্ষা কবেই বা এ দেশে প্রাধান্য পাইয়াছে? অতএব গ্যাস সিলিন্ডারের মহার্ঘতা তাহাকে ‘আপৎকালীন জ্বালানি’ করিয়া রাখিয়াছে। রন্ধনের প্রধান অংশ এখনও চিরাচরিত, অস্বাস্থ্যকর উপায়েই চলিতেছে।
আশঙ্কা হয়, প্রশাসন এই আংশিক ব্যর্থতার সমাধান বাহির না করিয়া, কেবল প্রচারযোগ্য পরিসংখ্যান জুটাইতেছে। মোদী সরকার এত দিন গ্যাস-সংযোগের দ্রুত বৃদ্ধি প্রচার করিত। সিলিন্ডার ব্যবহারে বৃদ্ধির সামান্যতা গোপন করিত। এই বার সরকারের সেই লজ্জার অপনোদন কিছুটা হইতে পারে। সিলিন্ডার ছোট হইলে স্বভাবতই তাহার বিক্রয় কিছু বাড়িবে। কিন্তু দরিদ্র মেয়েদের সমস্যা ঘুচিবে না। দ্রুত ফুরাইবার ভয়ে তাঁহারা আরও কম গ্যাস ব্যবহার করিবেন, সেই সম্ভাবনা যথেষ্ট। বরং ক্ষুদ্র সিলিন্ডার রাজকোষের উপর চাপ বাড়াইবে। কারণ, কেবল স্বচ্ছ জ্বালানিতে রাঁধিতে হইলে যত গ্যাস প্রয়োজন, দরিদ্রের নিকট তাহা তিন বারে পৌঁছাইতে হইবে। সরবরাহে খরচ তিন গুণ হইবে। দরিদ্রের গৃহে সিলিন্ডার গৃহশোভা হইয়াই থাকিবে কি?