প্রিন্সিপ্যালের পদত্যাগের দাবিতে জি ডি বিড়লায় অভিভাবকদের বিক্ষোভ। —ফাইল ছবি
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন হইতে একটি বৎসর মুছিয়া যাইবার ক্ষতিটি বড় কম নহে। অথচ জি ডি বিড়লা স্কুলের নার্সারির শিশুটি সামাজিক বিকারের শিকার হইয়া সেই ক্ষতিরই সম্মুখীন। যে অপ্রীতিকর ঘটনার অভিযোগে তাহাকে হেনস্তা হইতে হইয়াছে, সেই অভিযোগ যদি প্রমাণিত না-ও হয়, তবুও শিশুটি সামাজিক অন্যায়ের শিকার হইল। সম্প্রতি কলিকাতা হাই কোর্টে শিশুটির বাবার দায়ের করা এক মামলার প্রেক্ষিতে উঠিয়া আসিয়াছে তাহার দুরবস্থা। গত নভেম্বরে শিশুটির উপর বিদ্যালয় চত্বরে দুই শিক্ষক দ্বারা যৌন নিগ্রহের অভিযোগ উঠিবার পর হইতে পঞ্চমবর্ষীয় শিশুটির জীবনযাপনই পাল্টাইয়া গিয়াছে। ঘটনার পর হইতে সে আর নিজ স্কুলে যাইতে পারে নাই, বিকল্প স্কুলেরও বন্দোবস্ত করা যায় নাই। শুনিয়া উদ্বিগ্ন বিচার-কর্তৃপক্ষ। মাননীয় প্রধান বিচারপতি অবিলম্বে শিশুটির পঠনপাঠন শুরুর নির্দেশ দিয়াছেন।
অপ্রীতিকর ঘটনার জের যে শিশুটির জীবনে পড়িয়াছে, তাহার পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করিয়া তাহাকে মূলস্রোতে ফিরাইয়া আনিবার দায়িত্বটি কাহার? আপাতদৃষ্টিতে মনে হইতে পারে, ইহা শিশুর অভিভাবকদেরই দায়। তাঁহাদেরই তো নিশ্চিত করিবার কথা, সন্তান যাহাতে পড়াশুনা এবং খেলাধুলার মধ্য দিয়া একটি সুস্থ শৈশব যাপন করিতে পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ বাহিরের কোনও ঘটনায় যদি শৈশব কোনও কারণে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং সেই ঘটনার অকুস্থল যদি শিশুর নিজের বিদ্যালয়ই হয়? তাহা হইলেও কি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কিছু দায় থাকিয়া যায় না? প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তো বটেই, মানবিক দায়টিও বিদ্যালয়ের মাথায় রাখিবার কথা। অভিভাবকরা শিশুটিকে বিদ্যালয়ের আপাত-নিরাপদ আশ্রয়ে দিয়া যাইবার পর তাহার দেখভালের দায়িত্বটি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরই। সেই সময়ের মধ্যেই নিগ্রহের ঘটনা ঘটিয়াছে কি না, কী ধরনের নিগ্রহ, কে অপরাধী, সত্য উদ্ঘাটিত হওয়া এখনও সময়ের ব্যাপার। অভিযুক্ত শিক্ষকদের ভূমিকা, তাঁহাদের নিয়োগপদ্ধতি, স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়, সমস্ত কিছুই তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু অভিযোগ, তদন্ত, মামলা ইত্যাদির বাহিরে শিশুটির ভবিষ্যৎ মাথায় রাখিবার কাজটি কি আরও গুরুতর নয়? সঙ্গত অস্বস্তিতে শিশুটি যদি ওই বিদ্যালয়ে ফিরিতে না পারে অন্য বিদ্যালয়ে তাহার ভর্তির ব্যবস্থাও করিতে হইবে। সে কাজটিও প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হিসাবে তাহার বিদ্যালয়কেই লইতে হইবে। কোনও অবস্থাতেই সেই বিশাল দায়িত্ব ঝাড়িয়া ফেলা যায় না।
মাননীয় বিচারপতি এই কথাটিই বলিয়াছেন। দুর্ভাগ্য এই দেশের যে, বিদ্যালয়ের স্বাভাবিক মানবিক কর্তব্য কী, তাহাও আদালতকেই বলিয়া দিতে হয়। দায়িত্ব ঝাড়িয়া ফেলার রেওয়াজটি এই সমাজে এমনই স্বাভাবিক যে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র একই চিত্র দৃশ্যমান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর বিবিধ সমস্যায় সম্পূর্ণ নীরব থাকা এবং পরিশেষে তাহাকে প্রতিষ্ঠান ছাড়িতে বাধ্য করার নজির বহু পাওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভর্তির অর্থটুকু ফেরত দিবার সৌজন্যটুকুও প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে দেখা যায় না। সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর শিক্ষার্থীদের যে পুঞ্জীভূত অসন্তোষের নমুনা দেখা যাইতেছে, তাহার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, প্রতিষ্ঠানের দিক হইতে সাধারণ ভাবেই সহানুভূতি ও সৌজন্যের একান্ত অভাব।