দেশভাগের বহমান ইতিহাস

এই কথাটিই একটা বৃহত্তর প্রেক্ষিতে উঠে এল যখন সমাজতত্ত্ববিদ রণবীর সমাদ্দার বললেন, গোটা ইউরোপই তো এখন সীমান্ত সমস্যা, উদ্বাস্তু এবং অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে সমস্যায় ভুগছে।

Advertisement

অনিন্দিতা ঘোষাল

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share:

ভাবলে আশ্চর্য লাগে যে, পৃথিবীর কোনও অভিধানেই ‘স্বাধীনতা’ ও ‘দেশভাগ’ সমার্থক শব্দ হতে পারে না, বরং এদের পরস্পরবিরোধী হওয়ারই কথা। এ দিকে আমাদের দেশে ১৯৪৭ সালের ঘটনাপর্যায় দুটি শব্দকে প্রায় প্রতিশব্দ করে দিয়েছে! ক’দিন আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড ইন্ডিয়া রিসার্চ ইন্সটিটিউট ও ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলিংটন-এর যৌথ উদ্যোগে ‘পার্টিশন ইন বেঙ্গল: লুকিং ব্যাক আফটার সেভেন্টি ইয়ার্স’ শীর্ষক আলোচনাচক্রে দেশভাগ গবেষণার বিচিত্র ধারার কথা শুনতে শুনতে এটাই ভাবছিলাম।

Advertisement

সে দিনের আলোচনায় ইতিহাসবিদ শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর ধারণার ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ার পর দুটি স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রেই নতুন সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু শ্রেণি তৈরি হল, এবং তাদের অস্তিত্ব ও সুরক্ষাও নির্ভরশীল হয়ে পড়ল দুই রাষ্ট্রের তৈরি নীতির ওপর। দুই দেশে দুই রকম রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্পেষণে সংখ্যালঘু সমাজ, সংখ্যাগুরু সমাজ, শরণার্থী, দলিত, এমনকী আইনি ভাষায় যাঁরা রাষ্ট্রহীন, সেই মানুষরা— সকলেই দেশভাগের অন্তঃসারশূন্যতাকে স্বাধীন দেশের মধ্যে নানা ভাবে অনুভব করলেন। অর্থাৎ দেশভাগ হল প্রথমে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ব্যবহার করা সমাধান সূত্র, তার পর নতুন রাষ্ট্র তৈরির হাতিয়ার।

এই কথাটিই একটা বৃহত্তর প্রেক্ষিতে উঠে এল যখন সমাজতত্ত্ববিদ রণবীর সমাদ্দার বললেন, গোটা ইউরোপই তো এখন সীমান্ত সমস্যা, উদ্বাস্তু এবং অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে সমস্যায় ভুগছে। দেশকে ভাগ করে কি কখনও একটা ‘right size’ বা ‘right shape’-এর রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব হয়? হয় না। তাই দেশভাগ যতটা না সমস্যার সমাধান করে, তার থেকে বেশি সমস্যার সূত্রপাত করে। ধরা যাক, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো। রাষ্ট্রের নীতিগত সমস্যা কী সাংঘাতিক রূপ ধারণ করতে পারে, আমরা তাদের দেখে বুঝতে পারি। দেশভাগের সময় যখন মানচিত্র দেখে পাহাড় ও নদীর ওপর সীমারেখা টানা হল, কিন্তু আদিবাসীদের সেই ভূমির বাসিন্দা হিসেবে ভাবা হল না। তাই তাদের ত্রাণ-পুনর্বাসন কথাটাও রাষ্ট্রের মাথা থেকে বাদ পড়ে গেল। পাকিস্তান-বাংলাদেশের বাদ দিয়ে কেবল ভারতের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা দলিত সম্প্রদায় নিয়ে রাষ্ট্রের অবস্থান আজও কতখানি সমস্যাজনক। এর সঙ্গে যখন যোগ হয় নির্দিষ্ট জাতিসত্তা বা ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য তৈরির প্রবণতা, সমস্যার পরিমাণটা আন্দাজ করা যেতে পারে।

Advertisement

আলোচনা শুনতে শুনতে তাই মনে হচ্ছিল, রাষ্ট্র আসলে কী? তত্ত্বে যেমন পড়া যায়, রাষ্ট্র কি তবে সেই শ্বাপদ জন্তুদের সঙ্গেই তুলনীয়? প্রথমে তারা নিজেদের ‘বিচরণের ভূমি’ তৈরি করে, তার পর সুরক্ষার নামে তাকে চিহ্নিত করে বলে দেয়, কতখানি বৈধ, আর কতখানি নয়, কে থাকতে পারে আর কে থাকতে পারে না? তারই মধ্যে নাগরিক/ অ-নাগরিকরা রাষ্ট্রের আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সীমান্ত বস্তুটিকে পাত্তা না দিয়ে একটা সমান্তরাল চলমানতা তৈরি করে চলে, বলছিলেন হৈমন্তী রায়। অর্থাৎ দেশভাগ ও দেশনির্মাণ যখন একত্রে চলে, তা আসলে অনেকগুলো বিকল্প অস্তিত্ব তৈরি করে ফেলে, কোনও একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় আদলে রেখে একে ব্যাখ্যা করাই মুশকিল হয়ে যায়। বিভিন্ন শ্রেণি ও বিভিন্ন জাতির মানুষরা রাষ্ট্রেরই নির্দেশে নিজেদের নতুন অস্তিত্বের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, নানা ভৌগোলিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে তৈরি হয় কত রকম আঞ্চলিক জন-সমাজ, আলাদা আলাদা প্যাটার্নের।

সারা দিন ধরে তত্ত্ব ও তথ্যের এই যোগবিয়োগ শুনে ফেরার সময় আমার এক অধ্যাপক বন্ধুর দাদুর কথা মনে পড়ল। মৌলবিবাজারের বাড়িতে বসে তিনি গল্প করেছিলেন, স্বাধীন ভারত তৈরির আনন্দের মধ্যে হঠাৎ তাঁরা জানতে পেরেছিলেন যে তাঁরা আর ভারতে নেই, ওই জায়গায় দেশটা পাকিস্তান হয়ে গেছে। আবার অনেক বছর পর আর এক সকালে, এক জন এসে তাঁকে জানিয়েছিল, তিনি ও তাঁরা যেখানে বসে আছেন, সে দেশটার নাম পালটে হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। তিনি নিজে কখনও গ্রামের সীমানার বাইরে যাননি, তবু তিনি পর পর তিনটি দেশের অংশ হয়ে গেলেন!

আচ্ছা, ওই বৃদ্ধ মানুষটি দেশ বা রাষ্ট্র বলতে ঠিক কী বুঝতেন? এই যে ‘নেশন স্টেট’ নিয়ে এত হইচই, এই সব নাগরিকের কাছে তার সংজ্ঞা কী? রাষ্ট্র কি তা হলে কেবলই রাষ্ট্রনীতি আর রাজনীতির অমোঘ নির্মাণ? সাধারণ মানুষের অংশিদারিত্বে তার নির্মাণ হয় না? মানুষের মেনে নেওয়া অথবা না নেওয়ার কোনও সুযোগ সেখানে থাকে না? প্রশ্নগুলো থেকে গেল, থেকে যায়। আর তাই, ‘দেশভাগের ইতিহাস’ বস্তুটা শুধু রোম্যান্টিক স্মৃতিচারণ বা দাঙ্গা-হিংসার সমালোচনায় বেঁধে রাখার মতো বিষয় নয়। এ আসলে একটা বহমান ইতিহাস, যা আমরা আজও রোজই চার পাশে দেখছি। নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের এক সমুদ্র দূরত্বের মধ্য দিয়ে।

ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement