সত্যজিতের স্ত্রী ও ছেলে।
সেই যে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে বৈরাগী গেয়ে উঠেছিল— ‘একে তো ফাগুন মাস, দারুণ এ সময়’।
বসন্ত। এর চেয়ে বিভ্রান্তিকর ঋতু আর একটাও নেই। হেমন্ত তবু কিছুটা চেষ্টা করে, কিন্তু ওই ছাতিম ফুল-টুলের একটা রেশ থাকার দরুণ মানিয়ে নেওয়া যায়। এই সময়ে জোর করে বসন্তের ভয় দেখিয়ে সজনে ডাঁটা চিবুতে চিবুতে বলা হয়, মাঝরাতে উঠে ফ্যানের অনুভূতি রেগুলেট করতে হয় অভিমানী চাদরটাকে পায়ের সামনে ফেলে রেখে। সর্দি-গর্মি বাঁধা এক্কেবারে, কিছুতেই আটকানো যাবে না। তবু বসন্ত। প্রকৃতির বর্মীবাক্সে এ কালেই লাভ বাগে বসায়েছে দাঁত। বর্ষা সুয়োরানি হয়েই হয়েই রয়ে গেল আর গ্রীষ্ম ইত্যাদিরা তো ঝাড়পিট হিরো। কেন এমন হল, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে হয়েছে বটে।
বাঙালি আবার সবেতেই এক কাঠি আনপ্রেডিক্টেবল। প্রায় সকলেই যখন ধর্ম বিষয়টাকে কেন্দ্র করে ভালবাসা, প্রেম, ইত্যাদি ‘অসভ্য’ বিষয়গুলোর উপর ফতোয়া শানাচ্ছে, বাঙালি তখন একটা পুজোকেই করে নিল ভালবাসার দিন। সেও ওই, বসন্তেই। এ ছাড়া, ভ্যালেন্টাইন্স ডে তো রয়েছেই। এ সময়ে চারপাশ জুড়ে চোখে পড়বে শুধু মন ভাল। আর মনকেমনের দল? তারা কেমন আছে?
সেই মেয়েটা? যার মনে পড়ে শুধু ভাল সময়গুলো। কিন্তু মানুষটাকে মনে পড়ে না আর। বা সেই ছেলেটা? যার আর দেশে ফেরা হবে না এই বার বসন্ত পূর্ণিমায়। তারা? এক দিন হঠাৎই আর যেমন ফিরল না কারওর ভালবাসার মানুষ। অ্যাক্সিডেন্ট, খুন? এই যেমন পুজোর মধ্যে খুন হয়ে গেলেন বিধায়ক। তাঁর বাড়ির লোক, প্রিয়জন? কেমন কাটাচ্ছেন ওঁরা এই বসন্তের দিন? কিংবা ওই বৃদ্ধা, যিনি সেই আদিম শীতের শুরু থেকে পিঠে রোদ্দুর পেতে বৃদ্ধাশ্রমের বারান্দায় অপেক্ষা করছেন কাছের মানুষের একটু ফাঁকা সময়ের? তাঁরাও তো পার করলেন এই ফাল্গুন। এই পয়লা বসন্ত? আর এখানেই বাঙালি বিশেষ। শুধু অনূভুতি ছাড়া কিন্তু বসন্তের আর তেমন কিছু নেই। কোনও বসন্ত স্পেশ্যাল রান্না নেই, না আছে কোনও বসন্ত ছাপ্পা মারা কোনও ফল বা মিষ্টি। উৎসব তো হাতেগুনে দুটো আর আর তা-ও আবার একদিনের। শুধু অনুভূতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা গোটা সময়। বাঙালির সবচেয়ে সাধের সময়।
কারণ, বিষয়টা পরিবেশকে এমন করে রাখবে যাতে নিজেরই ইচ্ছে করবে নিজেকে লাই দিতে। বিকেলটা করে দেবে এমন যে, মনে হবে এই এক পলকে থেমে যাক শহরের যাবতীয় কালি পড়া দূষণ, তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিতে পারি সমস্ত মধ্যবিত্ততা। যদি ঠিক এই মুহূর্তে আরেক বার ঠিক ওই ভাবেই ছল বিরক্ত হত কেউ।
কেউ আবার নেই যাদের, ঝগড়া করার তাদের কী মনে পড়ে? পয়লা ফাল্গুন? না একলা ফাল্গুন? আজকাল আবার যেমন বসন্ত বুড়িছোঁয়া করে যায়। শীতের পরেই গরম। ফাল্গুন আসে যদি নিজের নিয়মেই। আসে না শুধুমাত্র তাদের জন্যে যাদের তারিখ মনে রাখার দায় নেই। কী হবে মনে রেখে, অভিমান করতেও তো একটা আদর লাগে। হোক না সে জানলার ধারে আধখোলা কাচের হাওয়া। শার্সি নামাতে তো বলতে হবে কাউকে। অধিকার ছাড়া, নিষেধ ছাড়া প্রেম হয়? ভালবাসা? হয়? যদি বলো হ্যাঁ, কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলতে তো হবে। উল্টোদিকে, বসন্ত আসলে একটা অবস্থা। একটা বেয়াড়া অবস্থানের ডাকনাম বসন্ত। আর বেয়াড়া যে কোনও জিনিসের প্রতিই আমাদের ভালবাসা সম্ভবত জিনবাহিত। সে চোর আলাদিনের জন্যে রাজকন্যে জেসমিনের আকুল করা প্রেমই হোক, বা সে দিনের সেই জামার হাতায় ঠিক করে নেওয়া চোখের কোণের কাজল।
সম্প্রতি ২০০,০০০ দো-পেয়ে মঙ্গলগ্রহে যেতে চেয়ে নাম লিখিয়েছে। দু'লাখ! এবং এটা জেনেশুনে নাম লিখিয়েছে যে বাকি জীবন ওখানেই কাটাতে হবে। ওয়ান ওয়ে টিকিট। ফেরার কোনও সম্ভাবনা নাই। নীল আকাশ, গামছা, চিকেন ভাজা, ফেসবুক, ডলফিন, মোচা-চিংড়ি, প্রজাপতি, রূপম একক, কলামন্দির, পার্বতী মেনন, প্রাক্তন, বাড়ির লোক, পাড়া, ইত্যাদি প্রভৃতি আর যা যা কিছু ভাবতে পারেন, সেই সব তাঁদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবে না আর কোনও দিন। কখনও লালচে সন্ধ্যার দিকে রাস্তায় চায়ে জিভ পুড়ে যাবে না। এটা জেনে-শুনে-বুঝে সাধ করে নাম লিখিয়েছেন দু’লাখ লোক। আমার ধারণা, ফর্ম ফিলাপের আঁটঘাঁট আরেকটু ইউজার বা থার্ডওয়ার্ল্ড ফ্রেন্ডলি হলে সংখ্যাটা দশ কুড়ি দিয়ে গুণ হয়ে যেত। পাঠানো হবে অবশ্য কড়ে গোনা দু’চার জনকেই। কিন্তু তা-ও দু’লাখ! ধরে নিলাম, কেউ কেউ খুবই বিজ্ঞান ভালবাসে বা নোলানের ফ্যান। জামায় রিসাইকলের লোগো লাগিয়ে ঘোরেন। নেহাত একটা জুতসই মই পাচ্ছেন না তাই। তা না হলে সেটা বেয়ে উঠে ওজোন ফুটোয় আঠা গুঁজে দিতেন। কিন্তু বাকিরা?
মানুষ কি এতটা একা? এতটা বন্ধুহীন?
আমার যে কোনও বন্ধু যদি এমন কিছু করত, তা হলে তাকে ডাকতাম। তার পর নড়া ধরে মোদকে নিয়ে গিয়ে লুচি খাইয়ে বলতাম— ‘‘এ বার ভাব যদ্দিন না ইএমআই-এর আওতার বাইরে যাচ্ছিস, তদ্দিন এসব আর পাবি না।’’ আরে! যাদের সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা মারি, তাদের কেউ একটা সাত দিন শিলিগুড়ি ট্যুরে গেলেই কেমন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে আর এ তো মঙ্গল!
আমি যদি এমন করতাম, তা হলে আমার হাত-পা ভেঙে দেওয়া হত। কারণ কেউ না কেউ কখনও না কখনও ধরে রাখবেই। রাখতে বাধ্য। এমনটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ছোট ছোট বিষয়গুলোই মানুষকে মানুষ করে। মানুষের বন্ধু আছে। আড্ডা আছে। পরিকল্পনা আছে। পিছুটান আছে।
এই সব আবেগ, উষ্ণতা, অনুভূতি ক্রমশ কমে যাচ্ছে কেন?
এই যে এতজন একা মানুষ, বসন্ত তাঁদেরও। ফাল্গুন আসে তাদের সময়েও। তবে? আসলে সকলেই ওই একটা কোণের অংশীদার হতে চাইছেন। যেখানে থাকবে সেই রোজকার মুখ। সেই বাড়ি ফেরার তাড়া, সেই টাকা গোনার তাড়া। আবার, যাঁরা মঙ্গলে যেতে চেয়ে নাম লেখালেন, চোখ কপালে তুলে তাঁদের সমালোচনা করে বলবেন— কত পার্সোনাল স্পেস চাই যে, স্পেসে যেতে হবে?
আসলে কিন্তু সকলেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেই বসন্ত সাম্রাজ্যের। আসলে জেলের ভিতরেও সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক শাস্তিটার নাম হল ‘সলিটারি কনফাইনমেন্ট’।
কিন্তু একমাঘে যেমন শীত যায় না তেমন এক মাসে ১লা ফাল্গুনও যায় না। তাঁদের জন্য আছে বেয়াড়া পৃথিবী। যেখানে, বসন্তই বিরাজ করে আজীবন। সেখানে সম্মান লাগে না, বাস্তব লাগে না। শুধু জোর লাগে, মনের জোর। আত্মবিশ্বাস লাগে, নিজের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার।
চিত্রনাট্যকার