নিয়ত নজরদারি এবং নিরন্তর ভারসাম্য রক্ষা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ইহাই কার্যপদ্ধতি। তাই রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গ বিপরীতে হাঁটিল। পঞ্চায়েত নির্বাচন আইনে সংশোধন করিয়া বিধায়ক, সাংসদদের এ বার পঞ্চায়েতের পদাধিকারী হইবার রাস্তা খোলা হইল। ইহাতে ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতি ক্ষুণ্ণ হইল, যাহা অনেক রাজনৈতিক দলও মানিয়া চলে। সময় সীমিত, কাজ বিস্তর, তাই একই ব্যক্তির ঘাড়ে একাধিক পদ চাপাইলে কোনও একটির প্রতি অবিচার হইবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। অপর কারণ, নজরদারি ও ভারসাম্য বজায় রাখিবার প্রক্রিয়া বানচাল হইবার সম্ভাবনা। প্রশাসনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাহার নিজস্ব নিয়মে কাজ করিবে, এবং কোনও একটি নিয়ম লঙ্ঘন করিলে অপরগুলি তাহাকে বাধা দিবে, ইহাই দস্তুর। একই ব্যক্তি দুইটি ভিন্ন পদে থাকিলে প্রশাসনের দুইটি বিভাগের পরস্পরের প্রতি জবাবদিহির দায় কমিয়া যায়। তাহাতে বিধি মানিবার বিভাগীয় শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়, কোনও একটির দ্বারা অপরটিকে প্রভাবিত করিবার সম্ভাবনা থাকিয়া যায়।
এই সংশোধনের সমর্থনে পুরসভার সদস্যদের বিধায়ক হইবার নিয়মের দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু এই উদাহরণটি কি আশ্বস্ত করিতে পারে? কলিকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় রাজ্যের পরিবেশ মন্ত্রী হইবার পরে পূর্ব কলিকাতার জলাভূমি বুজাইয়া ঘরবাড়ি নির্মাণের ঘটনা দ্রুত বাড়িয়াছে। এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা ‘ইস্ট ক্যালকাটা ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’-প্রদত্ত তথ্য তেমনই সাক্ষ্য দিতেছে। পরিবেশ মন্ত্রকের দুর্নীতির অভিযোগ আনিয়া শহরের বিশিষ্ট নাগরিকেরা পরিবেশ মন্ত্রীর ইস্তফার দাবিও তুলিয়াছেন। অভিযোগের সত্যতা এখনও প্রমাণ হয় নাই। কিন্তু পরিবেশ-বিষয়ক ছাড়পত্র দিবার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রক এবং নির্মাণের ছাড়পত্র দিবার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুরসভা— দুইটিরই শীর্ষে একই ব্যক্তি থাকায় নজরদারিতে শিথিলতা হইয়াছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠিতে বাধ্য। পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে সে প্রশ্নটি কম গুরুত্বপূর্ণ নহে। ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতের সকল ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট জমা পড়িয়া থাকে বিধানসভায়। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি তাহা পরীক্ষা করিয়া থাকে। যাঁহারা পরীক্ষার্থী, তাঁহারাই পরীক্ষকের পদেও আসীন থাকিবেন, ইহা কেমন ব্যবস্থা? ইহা ‘নজরদারির মাধ্যমে ভারসাম্য’ নীতি দুর্বল করিতে বাধ্য।
কিন্তু দুর্নীতির সম্ভাবনাই একমাত্র সমস্যা নহে। বিধায়ক ও সাংসদদের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় শামিল করিবার সিদ্ধান্ত বস্তুত পঞ্চায়েত ব্যবস্থার স্বাতন্ত্র্যে আঘাত। ভারতের সংবিধানের চোখে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের পর ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দেশের ‘তৃতীয় সরকার।’ তাহা অপর কোনও সরকারের অধীন নহে, অঙ্গও নহে। বিধায়করা পদাধিকারবলে তাহার সদস্য হইতে পারিতেন কেবল প্রশাসনিক সুবিধার জন্য। নির্বাচিত সদস্যের মর্যাদা ও দায়িত্ব বিধায়কের হাতে দিয়া পঞ্চায়েতের স্বাধীন সিদ্ধান্ত লইবার ক্ষমতাকে খর্ব করা হইল। প্রশ্ন উঠিতে পারে, ইহা যদি সম্ভব হইবে, তাহা হইলে বিধায়কদের সাংসদ পদে বসিতেই বা নৈতিক বাধা কী? জেলা পরিষদের সভাধিপতি, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি প্রভৃতি পদকে আংশিক সময়ের পদ করাও এক বিচিত্র সিদ্ধান্ত। যখন উন্নয়নের কর্মসূচিতে পঞ্চায়েতের ভূমিকা বাড়িতেছে, তখন কেন শীর্ষ পদাধিকারীরা তাঁহাদের সম্পূর্ণ সময় পঞ্চায়েতের কাজে ব্যয় করিবেন না, তাহার ব্যাখ্যা মিলিবে না। তবে কি রাজ্য পঞ্চায়েতের পদাধিকারীদের ‘এলেবেলে’ করিতে চায়? তাঁহারা কেবল চেয়ারে বসিবেন, কাজ করিবেন প্রশাসনিক কর্তারা এবং কতিপয় বিশ্বস্ত বিধায়ক-সাংসদ, ইহাই কি রাজনৈতিক অভিপ্রায়?