ধ্বংসই সৃষ্টি

সম্প্রতি মাদ্রিদের এক শিল্প মেলায় দেখা যাইল স্পেনের রাজা ফেলিপে-র এক ১৩ ফুট উচ্চ মূর্তি, যেটির ক্রয়শর্তই হইল, কিনিবার এক বৎসরের মধ্যে মূর্তিটি পুড়াইয়া ফেলিতে হইবে এবং সেই দহনের ছবি ক্যামেরায় তুলিয়া রাখিতে হইবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share:

এই সেই ছবি, নিলামে ১৪ লক্ষ ডলারে বিক্রয় হইবামাত্র ছবিটি নিজ হইতেই টুকরা টুকরা হইয়া গিয়াছিল। ব্যাঙ্কসির ইনস্টাগ্রাম পোস্ট থেকে নেওয়া।

সম্প্রতি মাদ্রিদের এক শিল্প মেলায় দেখা যাইল স্পেনের রাজা ফেলিপে-র এক ১৩ ফুট উচ্চ মূর্তি, যেটির ক্রয়শর্তই হইল, কিনিবার এক বৎসরের মধ্যে মূর্তিটি পুড়াইয়া ফেলিতে হইবে এবং সেই দহনের ছবি ক্যামেরায় তুলিয়া রাখিতে হইবে। প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়া একটি শিল্পবস্তু কিনিয়া তাহা ধ্বংস করিবেন কেন ক্রেতা? শিল্পীদ্বয়ের বক্তব্য, কারণ তিনি বস্তু নহে, কিনিতেছেন একটি ‘প্রক্রিয়া’। গত বৎসর সদবি’জ়-এর নিলামে ১৪ লক্ষ ডলারে একটি ছবি বিক্রয় হইবামাত্র সেই ছবিটি নিজ হইতেই টুকরা টুকরা হইয়া যাইতে লাগিল। ছবিটি আঁকিয়াছিলেন ব্যাঙ্কসি, তিনি ইদানীং প্রবল খ্যাত শিল্পী, মূলত রাস্তার ধারে প্রাচীরের গাত্রে ছবি আঁকিয়া থাকেন। ব্যাঙ্কসি পরে জানাইলেন, তিনি ছবিটির ফ্রেমের মধ্যে একটি ‘শ্রেডার’ বা কাগজ টুকরা করিবার যন্ত্র লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। ব্যাঙ্কসি কেন এই রকম করিলেন, তাহার কারণ হিসাবে একটি বাক্য উদ্ধৃত করিয়াছেন: ‘‘ধ্বংস করিবার তাড়নাও একটি সৃষ্টিশীল তাড়না।’’ ব্যাঙ্কসি বলিয়াছেন বাক্যটি পিকাসোর, যদিও প্রকৃতপক্ষে উহা রুশ নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনের। অনেকে অন্যের ছবি বা ভাস্কর্য ধ্বংস করিয়াছেন, প্রতিবাদের অঙ্গ হিসাবে। ১৯১৪ সালে মেরি রিচার্ডসন লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে কুঠার লইয়া ভেলাসকেস-এর বিশ্বখ্যাত ‘রোকবি ভেনাস’ চিত্রটিকে আক্রমণ করেন। বলেন, তিনি পৌরাণিক ইতিহাসের সর্বাধিক সুন্দরী মহিলাকে ধ্বংস করিলেন কারণ এই দেশের সরকার বর্তমান ইতিহাসের সর্বাধিক সুন্দর চরিত্রের মহিলাকে ধ্বংস করিতেছেন। তাঁহার ইঙ্গিত ছিল এমেলিন প্যাঙ্কহার্স্ট-এর প্রতি, যিনি মহিলাদের ভোটাধিকারের জন্য সেই মুহূর্তের ইংল্যান্ডে প্রধান আন্দোলনকারিণী।

Advertisement

বিখ্যাত চিনা শিল্পী আই ওয়েওয়ে ১৯৯৫ সালে একটি দুই সহস্র বৎসরের প্রাচীন বহুমূল্য মৃৎপাত্র ফেলিয়া ভাঙিয়া দিয়া বিখ্যাত হন, তিনি ওই কর্মটিকেই একটি শিল্পকৃতি হিসাবে উপস্থাপিত করেন। অনেকে বলেন, ইহার দ্বারা বস্তুটি তাহার আদি মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যবান হইল, কেহ বলেন ইহার দ্বারা শিল্পী আমাদের প্রাচীন শিল্পবস্তুর প্রতি অবহেলার কথাই স্মরণ করাইয়া দিলেন। জার্মান শিল্পী গুস্তাভ মেৎজ়ার নিজ শিল্পে ধ্বংস, ক্ষয়, ক্ষতিকে আনিতে চাহিয়াছিলেন, তিনি ১৯৬৬ সালে একটি বিশাল নাইলনের চাদরে অ্যাসিড ঢালিয়া দিতে সেইটি বিভিন্ন স্থানে গলিয়া পড়িয়া রকমারি নকশা তৈয়ারি করিতে লাগিল। সুইৎজ়ারল্যান্ডের ভাস্কর জঁ তঁগলি বহু প্রকার বস্তু ও লৌহ-আবর্জনা লইয়া এমন সব স্বনির্মিত যন্ত্রে সেইগুলি রাখিতেন, যাহা ক্রমে সেইগুলিকে ধ্বংস করিয়া ফেলিবে। ব্রিটিশ শিল্পী মাইকেল ল্যান্ডি ২০০১ সালে নিজের সম্পত্তি যতগুলি বস্তু ছিল, প্রতিটিকে ধ্বংস করেন (১২ জন সহকারী মিলিয়া)। মোট ৭,২২৭ বস্তুকে ধ্বংস করিতে দুই সপ্তাহ লাগিয়াছিল, শেষ হইবার পর, তাঁহার সম্পত্তি বলিতে কিছু ছিল না, কেবল যে জামাকাপড় তিনি পরিয়াছিলেন, তাহা ব্যতীত। বস্তু আমাদের ক্রমে গ্রাস করিতেছে কি না, তাবৎ সম্পত্তি সরাইয়া লইলে এক ব্যক্তির পরিচয়ের কিছু পড়িয়া থাকে কি না, আরও বহু জটিল প্রশ্ন উঠিয়া আসিয়াছিল এই ‘শিল্প প্রদর্শনী’তে। রাফায়েল ওর্তিজ় ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ প্রদর্শনীর প্রথম দিন একটি গ্র্যান্ড পিয়ানোকে হাতুড়ি দিয়া ভাঙেন দর্শকসমক্ষে। আবার প্যারিসের পম্পিদু সেন্টারে প্রদর্শিত এক প্রস্রাবপাত্র (উপরে লেখা ‘দ্য ফাউন্টেন’, মার্সেল দুশ্যাঁ-র ১৯১৭ সালের বিশ্বখ্যাত দাদাবাদী শিল্পকর্মেরই এক নকল) হাতুড়ি দিয়া ধ্বংস করিলেন ফরাসি শিল্পী পিয়ের পিনঁচেলি। তাঁহার বক্তব্য, একটি বিপ্লবী ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী কর্মকে আজ প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত করা হইয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে তাঁহার প্রতিবাদ।

বহু মানুষ বহু কারণে শিল্প ধ্বংস করিতেছেন, কাহাকেও বলা হইতেছে গুন্ডা, মস্তান, কাহাকেও বলা হইতেছে যুগান্তকারী শিল্পী এবং কোটি কোটি টাকা দেওয়া হইতেছে ধ্বংসকাজের জন্য। বহু সময়ে এই সম্মান নির্ভর করে শিল্পীর অন্যান্য কাজের উপর, কখনও তাঁহার কাজটির নেপথ্যের দর্শন শিল্প-পণ্ডিতদের আকর্ষণ করিতেছে কি না তাহার উপর, কখনও গণমাধ্যম এইটিকে কেমন ভাবে উপস্থাপিত করিতেছে তাহার উপর। যাহাই হউক, চমক দিবার ইচ্ছা বা আন্তরিক প্রতিবাদ, ধ্বংসের প্রবণতাকে শিল্পসৃষ্টি বলিয়া যদি সমাদরের প্রচলন ঘটে, কোন দিন হয়তো বিদ্যাসাগরের মূর্তির মুণ্ডচ্ছেদকেও কেহ যুগান্তকারী ইনস্টলেশন বলিয়া দাবি করিয়া বসিবে!

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

বেশ একটা ‘আজ বাদে কাল যুদ্ধু হবে’ নিশ্চয়তা এসেছিল, মেরুদাঁড়ায় ‘জোশ’ এসে বসেছিল ধারালো নখ বার করে, ফের সব থিতিয়ে গেল। আইপিএল-ও আসতে কিছু দেরি। মধ্যিখানটায় তবে জনগণ করে কী? দূরদর্শনের প্রাচীন বাজনার সঙ্গে যুবকের নাচ, বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে অভিনেত্রীর নাচ নিয়ে আর কত বুঁদ থাকা যায়? ‘হ্যাপ্পি উম্যানস ডে’ পাঠানোও শেষ। বরং সবাই স্বরচিত রাফাল নথি তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীকে জমা দিন, দেশের কাজে লাগবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন