গন্ধে গন্ধ ঢাকে, শব্দ ঢাকে কিসে? শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের কাঁটা’ উপন্যাসের শেষে দেখা গিয়েছিল, শব্দও ঢাকা পড়ে যায় শব্দে। যেমন প্রশ্ন ঢাকে প্রশ্নে। যে চল্লিশ হাজার শিক্ষক প্রাথমিক স্কুলে নিয়োগপত্র পেয়েছেন এ বছর, তাঁদের নিয়োগ কি বৈধ? প্রশ্নটা এখন কলকাতা হাইকোর্টে। টেট পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করেনি দফতর। জনে জনে মোবাইলে বার্তা দেওয়া হয়েছে, তাঁরা চাকরি পেয়েছেন। পক্ষপাত, দুর্নীতির আশঙ্কায় আদালতে আবেদন করা হয়েছে, এই অস্বচ্ছ পদ্ধতি খারিজ হোক। নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটির জন্য গত মার্চে ত্রিপুরায় দশ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের ইস্তফার দাবি উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে সুতোয় ঝুলছে তার চারগুণ লোকের নিয়োগ। পঞ্চায়েত নির্বাচনে কী প্রভাব পড়বে প্রতিকূল রায়ের, এ প্রশ্ন রোজ আরও একটু ফুলেফেঁপে উঠছে।
তার আড়ালে ঢাকা পড়ছে আরও বড় এক প্রশ্ন: আরও চল্লিশ হাজার শিক্ষক সত্যিই দরকার ছিল?
কেন্দ্রকে দেওয়া রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ থেকে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলে ২১ জন ছাত্র পিছু আছেন এক জন শিক্ষক। শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে থাকার কথা ৩০ জনে এক জন। স্কুল-প্রতি শিক্ষকের গড়ও মন্দ নয়, ৩.৯। অর্থাৎ চারটি ক্লাসের জন্য চার জন শিক্ষক পাওয়ার কথা অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুলের। শিক্ষক তো তা হলে কম নেই।
বরং ছাত্রের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ২০০৮-এ প্রথম শ্রেণিতে ছিল ২২ লক্ষের বেশি পড়ুয়া। ২০১৫-য় সেটা ১৭ লক্ষের কম। শুধু বীরভূমে গত তিন বছরে প্রথম শ্রেণিতে নাম-লেখানো পড়ুয়ার সংখ্যা কমেছে ১২ হাজারের বেশি। কেন, সরকারি তথ্যে তার কোনও ব্যাখ্যা মিলছে না।
সরকারি স্কুলের খাতার অংকে জল রয়েছে, একান্তে মেনে নেন শিক্ষাকর্তারাও। একই ছাত্রের নাম একাধিক সরকারি স্কুলে লেখানো থাকে। ভূতুড়ে ছাত্র খাতায় হাজিরা দিয়ে যায়, ভাত খেতে পারে না। জলপাইগুড়ির মালবাজারে কুমারপাড়া গ্রামের লোকেরা মিড ডে মিলের হিসেব ও পোশাকে কারচুপি নিয়ে গত বছর জানুয়ারিতে অভিযোগ করেন। তদন্তে পুলিশ দেখে, স্কুলের খাতায় বাড়তি প্রায় একশো ছাত্রের নাম। বোলপুরের এক প্রধান শিক্ষকের আন্দাজ, ‘বোলপুর পশ্চিম’ সার্কল-এ অন্তত কুড়ি শতাংশ ‘ডুপ্লিকেট’ ছাত্র আছে।
তারা তো আসেই না, সত্যি-ছাত্ররাও প্রায়ই আসে না ক্লাসে। ‘অসর’ সমীক্ষা বলছে, এ রাজ্যে গ্রামের স্কুলে ক্লাসে ছাত্রের উপস্থিতি ষাট শতাংশ। গ্রামের স্কুলে ঘুরলেও দেখা যায়, সাধারণত স্কুলে অর্ধেক ছেলেমেয়ে আসে, শিক্ষকরা খুব উদ্যোগী হলে সত্তর-আশি শতাংশ। অনুপস্থিত ছাত্ররা হয় স্কুলছুট, নইলে সরকারি স্কুলে নাম লিখিয়ে পড়তে যায় প্রাইভেট স্কুলে। মানে ক্লাসরুমে পাঠদানে শিক্ষক-ছাত্রের প্রকৃত অনুপাত আরও কম।
হিসেবে ধরতে হবে সেই শিক্ষকদেরও, যাঁদের স্কুলের সরকারি স্বীকৃতি মেলেনি। তাই সরকারের শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতের হিসেবে এঁদের ধরা হয় না। কিন্তু রাজ্যে অন্তত হাজার দশেক অনুমোদনহীন প্রাথমিক স্কুল চলছে, শিক্ষক কম করেও চল্লিশ হাজার। তাঁদের বেতন জোগাচ্ছেন রাজ্যবাসীই। তারও উপরে তাঁদেরই টাকায়, অর্থাৎ করদাতার টাকায়, আরও শিক্ষক নিচ্ছি আমরা। কেন?
কারণ সরকারি স্কুলের ফাঁকা আসন ভরতে হবে। কিন্তু আসন ফাঁকা কি শিক্ষকের অভাবে? না কি তা সুষ্ঠু বণ্টনের অভাব? হুগলিতে শিক্ষক-পিছু ছাত্র ১৮, উত্তর দিনাজপুরে ৩৩। মালদহের ইংরেজবাজারে শিক্ষক-পিছু ছাত্র ২২, সীমান্তঘেঁষা হরিশচন্দ্রপুর ২ ব্লকে ৫০। সময়ের সঙ্গেও উন্নতি হচ্ছে না। বীরভূমে দেখা যাচ্ছে বোলপুরে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ভাল থেকে আরও ভাল হয়েছে (গত তিন বছরে ১৮ থেকে ১৭), প্রত্যন্ত এলাকা মন্দ থেকে আরও মন্দ (নলহাটি দক্ষিণে ৩০ থেকে ৩২), বা মন্দের উনিশ-বিশ (মুরারইয়ে ৪১ থেকে ৪০)।
সম্প্রতি নতুন নিয়োগ কি ছবি বদলাতে পারল? অনেক ক্ষেত্রে শহরের উদ্বৃত্ত-শিক্ষক স্কুলও নতুন শিক্ষক পাচ্ছে, প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের কপালে শিকে ছিঁড়ছে না। বহরমপুর স্পোর্টিং ক্লাব স্কুলে এগারো জন ছাত্র, এক জন শিক্ষক। ফের শিক্ষক পেয়েছে। সাগরদিঘির ইসলামপুর পূর্বপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ১০৩ জন পড়ুয়া, এক জন শিক্ষক নিয়ে শূন্য হাতে বসে রইল। কোচবিহার শহর-লাগোয়া টাপুরহাটে বড়ুয়াবাড়ি প্রাইমারি স্কুল ষাট জন ছাত্র, পাঁচ জন শিক্ষক নিয়েও পেয়েছে নতুন এক জন। আর প্রত্যন্ত সিতাই-লাগোয়া, ধরলা নদী-ঘেঁষা দরিবস প্রাইমারি স্কুলে ছাত্র শ’খানেক, শিক্ষক এক জন। এ বছর প্রাপ্তি বলতে এক অস্থায়ী শিক্ষক।
যে শিক্ষকরা এখন গ্রামে যাচ্ছেন তাঁরাও কত দিন থাকবেন? বদলি করতে তবু কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়। তৃণমূল আমলে চলছে ‘ড্রাফটিং’ রীতির অপব্যবহার। হঠাৎ প্রয়োজনে স্কুল ইনস্পেক্টর কোনও শিক্ষককে অল্প ক’দিনের জন্য অন্য স্কুলে পাঠাতে পারতেন। তার সুযোগ নিয়ে এখন তিন-চার বছরও অন্য স্কুলে পড়াচ্ছেন ‘বদলি’ শিক্ষক। বেতন নিচ্ছেন ‘মাদার’ স্কুল থেকেই। ফলে গ্রামের স্কুলগুলোতে বাস্তব শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত কী, তা কলকাতার কর্তারাও জানেন না। নদিয়ার একটি সার্কল-এর স্কুল ইনস্পেক্টর জানালেন, তাঁর এলাকায় অন্তত দশটি প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুল এ ভাবে শিক্ষক হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু তিনি নাচার। জেলার শিক্ষাকর্তাদের নির্দেশ মানতে বাধ্য এসআই-রা। মুর্শিদাবাদের বাম শিক্ষক সংগঠন এবিপিটিএ-র নেতা নবেন্দু সরকারের দাবি, গত তিন-চার বছরে পাঁচশোর বেশি শিক্ষকের স্কুল বদল করা হয়েছে এমন অবৈধ পদ্ধতিতে। জেলাগুলোতে ওপেন সিক্রেট, সুবিধে মতো বদলির রেট নেতার ওজন বুঝে ষাট হাজার টাকা থেকে এক লক্ষ টাকা।
এমন বৈষম্যমূলক বণ্টন, যুক্তিহীন বদলির ফলে আসন ফাঁকা হয়। নতুন শিক্ষক নিলে করদাতার খরচ বছরে অন্তত তিন লক্ষ টাকা। এখনই দু’লক্ষাধিক সরকারি প্রাথমিক শিক্ষককে বেতন দিতে বছরে খরচ হয় পাঁচশো কোটি টাকারও বেশি। প্রশ্নটা অর্থসম্পদের তো বটেই। অপ্রয়োজনে করদাতার টাকা নষ্ট করার অধিকার কারও নেই। প্রশ্ন মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়েও। শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ালেই ছাত্ররা শিখবে বেশি, এমনটা ধরা চলে না। ‘অসর’ সমীক্ষা বলছে উল্টোটাই। এ রাজ্যে ২০১০ সালে অষ্টম শ্রেণির যত ছাত্র ভাগের অংক কষতে পারত (৬৭ শতাংশ), ২০১৬ সালে পারছে তার অর্ধেক (৩২ শতাংশ)। অথচ তখন শিক্ষক-পিছু ছাত্রের সংখ্যা ছিল উনত্রিশ, এখন একুশ। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, এই বিপরীত গতি দেখা যাচ্ছে প্রায় সব রাজ্যে। এ থেকে অন্তত এটুকু বলা যায় যে, বাড়তি শিক্ষক দিলেই পড়াশোনার উন্নতি হচ্ছে, এমন নয়। তাই ‘কত শিক্ষক?’ নয়, ‘কেমন শিক্ষা?’ সেই প্রশ্নটা বেশি জরুরি।
কিন্তু আরও বড় প্রশ্ন, চাকরি কই? গ্রুপ ডি কর্মীর চাকরিও যেখানে মহার্ঘ্য, শিক্ষকের চাকরি সেখানে স্বপ্ন। ‘আরও শিক্ষক কী হবে’, জিজ্ঞাসা করলেই আরও তীব্র স্বরে প্রশ্ন ওঠে, ‘শিক্ষক না হলে আমার ছেলেমেয়ে কী হবে?’ রাজনীতির নেতারা কখনও আইন মেনে, কখনও আইন ভেঙে, ছেলেমেয়েদের চাকরির জন্য অভিভাবকের মরিয়া চেষ্টার ফায়দা নিচ্ছেন। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্কটা কী, আজ আর বোঝা যাচ্ছে না।