ভোট কেবলই কৌশল নয়

মহারাষ্ট্রে বিদর্ভের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কোথায় বিজেপির সমস্যা

মহারাষ্ট্রের ছবিটাই দেখা যাক। বিজেপির হাল সে রাজ্যে হরিয়ানার মতো নয়। হরিয়ানায় বিজেপি সরকার গড়তেই হিমশিম। মহারাষ্ট্রে আসনসংখ্যা কমার পর প্রশ্ন কেবল শিবসেনাকে কতটা ক্ষমতা দেওয়া হবে এইটুকু নিয়েই।

Advertisement

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

জয়যোগ: বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী বিকাশ ঠাকরের জয়ে সমর্থকরা নতুন উদ্যমে রাস্তায় নেমেছেন, নাগপুর, ২৪ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই

অর্থনীতিই যে ভিত বা ‘বেস’, আর বাকি সব ওপরকার বায়বীয় ‘সুপারস্ট্রাকচার’, মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানার বিধানসভার নির্বাচনের ফল বার হতে এমন একখানা পুরনো আপ্তবাক্যে ফিরে যাওয়ার আবার একটা সুযোগ এসেছে। কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা থেকে শুরু করে ভোটের আগের দিনের পাকিস্তানি হানা: ‘বালাকোট জাতীয়তাবাদ’-এর আগুনে ফুঁ দিয়ে আবেগের দাবানল জ্বালানোর চেষ্টা হয়েছিল এ বারও। কিন্তু দুই রাজ্যেই ভোটারদের একটা বড় অংশ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের রুজি-রোজগারের যে হাল এখন, তাতে এই সব কথায় লাভ নেই বিশেষ। লাভ কিসে হতে পারে, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোকেই ভাবতে হবে— শাসক দলের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধী দলগুলোকেও। বার্তাটা স্পষ্ট।

Advertisement

মহারাষ্ট্রের ছবিটাই দেখা যাক। বিজেপির হাল সে রাজ্যে হরিয়ানার মতো নয়। হরিয়ানায় বিজেপি সরকার গড়তেই হিমশিম। মহারাষ্ট্রে আসনসংখ্যা কমার পর প্রশ্ন কেবল শিবসেনাকে কতটা ক্ষমতা দেওয়া হবে এইটুকু নিয়েই। বিজেপি সরকারের পাঁচ বছরের পর স্থিতাবস্থাবিরোধী একটা ঢেউ থাকাটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু তবুও, ফলাফল দেখে নরেন্দ্র মোদী থেকে দেবেন্দ্র ফডণবীস কেউই কি খুশি হতে পারলেন? বিজেপি-শিবসেনা জোট আগের বারের চেয়ে এ বার ২৪টি আসন কম পেয়েছে। এর মধ্যে বিজেপির ভাগই বেশি, গত বারের ১২২-এর জায়গায় এ বার ১০৫— ১৭ আসন কম।

কিন্তু এতে অর্থনীতির ভূমিকা বোঝা যাচ্ছে কী ভাবে? কেননা, দেখা যাচ্ছে, বিজেপি খারাপ ফল করেছে প্রধানত গ্রামীণ অঞ্চলে— সেখানে তার ভোটের শতাংশ ২৪.৭৮, আর শহরে ৩১-এর ওপরে। (শরদ পওয়ারের এনসিপি গ্রামীণ অঞ্চলে পেয়েছে ২০.৬৮ শতাংশ ভোট আর শহর এলাকায় ৪.১৯ শতাংশ)। বিজেপির গ্রামীণ ভোটে ধাক্কাটা প্রধানত পূর্ব মহারাষ্ট্রে, যার নাম বিদর্ভ। এই একটি অঞ্চলেই আগের বারের থেকে ১৫টি আসন কম পেয়েছে বিজেপি। অর্থাৎ বিজেপির মাটি হারানোর পরিমাণ বিদর্ভের বাইরে মাত্র ২, সামান্যই বলা চলে— যদিও কেবল আসনসংখ্যা কমাই সমর্থন কমার একমাত্র চিহ্ন নয়। জেতা আসনগুলিতেও ভোটের ব্যবধান কমেছে, বহু ক্ষেত্রে। ভোটের ব্যবধান কমার মধ্যেও একটা গল্প থাকে বইকি। কিন্তু বিদর্ভে আগের বারের ৪৪ যে এ বার কমে গিয়ে ২৯ হল, এটাকে একটা আলাদা গুরুত্ব দিতেই হবে— সেই বিদর্ভ যেখানে কৃষিসঙ্কট ও কৃষকক্ষোভ প্রবল আকার ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। সেই বিদর্ভ, যাকে আক্ষরিক ভাবে ভারতের কেন্দ্রস্থল বলা যায়— মহারাষ্ট্র রাজ্যটির ৩১ শতাংশ জুড়ে আর জনসংখ্যার ২১ শতাংশ নিয়ে, নাগপুর শহরকে ঘিরে যার একটা আলাদা আইডেন্টিটি তৈরি হয়ে গিয়েছে, যে আইডেন্টিটির কথা আমরা অন্যান্য রাজ্যের লোক সচরাচর মনে রাখি না। বাস্তবিক, ‘কমলালেবুর শহর’ নাগপুর যে মহারাষ্ট্র রাজ্যের শীতকালীন রাজধানী, একটা দ্বিতীয় বিধানসভা বানানো হয়েছে সেখানে, সে খবরই বা কত জন রাখি।

Advertisement

সম্প্রতি অবশ্য আমরা বিদর্ভের কথা ঘন ঘনই শুনছি। এবং সেই সাম্প্রতিক প্রাসঙ্গিকতা দিয়েই এই ভোটের ছবির অনেকখানি ধরা সম্ভব। এই বছর অগস্ট পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে ১৭৯৯ জন চাষি আত্মঘাতী হয়েছেন— বিদর্ভে তার মধ্যে ৮২২ জন। আর গত বছরের শুরু থেকে অগস্ট পর্যন্ত সে রাজ্যের ১৭১৫ জন আত্মঘাতী চাষির মধ্যে বিদর্ভের চাষি ৮০৮। এই চাষিরা অধিকাংশই খুব দরিদ্র নন, বরং মধ্যস্থানভোগী, যাঁরা চাষ-খামারের জন্য ঋণ করে তার ফাঁদে পড়েছেন। একের পর এক বছর ধরে অসম্ভব খরা পরিস্থিতি, খারাপ ফসল, চাষ-খরচের অর্ধেকও তুলতে না-পারা, ফলত ঋণ শোধ করতে না-পারা, পাশাপাশি ঋণ মকুব নীতির রূপায়ণ না-হওয়া, এবং ব্যাঙ্কের নিদান যে দুই বছরের সুদ-সহ টাকা ফেরত না দিলে আর কোনও ঋণ সম্ভব নয়— এই হল সেই কুখ্যাত ফাঁদ, যা আত্মঘাত অবধি টেনে নিয়ে যায় হাজার হাজার লোককে। ২০১৭ সাল থেকে চৌত্রিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ মকুবের গল্প এঁদের কানে গিয়েছে। কিন্তু হাজার হাজার চাষি এই নীতির ছায়াটুকুও পড়তে দেখেননি তাঁদের সঙ্কটে। সেচ নিয়ে যে ব্যাপক হারে দুর্নীতি, তাতেও এঁদের ‘লাভ’ হয়নি, কেবল ক্ষোভের পারদ বেড়েছে চড়চড়িয়ে। এর সঙ্গে জুড়তে হবে ডিমনিটাইজ়েশন-এর প্রভাবকে। এবং সার্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকেও। কেনই বা এঁরা ‘বালাকোট জাতীয়তাবাদ’-এ ভুলবেন। অথচ এঁরাই কিন্তু ২০১৪ সালের বিধানসভায় অনেক আশায় বুক বেঁধে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, অচ্ছে দিন তাঁদের কাছে পৌঁছল বলে।

বিজেপি নেতারাও ভেবেছিলেন, চাষিরা যা-ই বলুন কিংবা করুন, দিন সেখানে অনেকটাই পাল্টানো গিয়েছে। কিছু দিন আগেই সে রাজ্যের বিজেপি অর্থমন্ত্রী সুধীর মুনগান্তিওয়ার মন্তব্য করেছিলেন, বিদর্ভ জুড়ে বানানো হয়েছে ভাল ভাল রাস্তা, সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট বা আইআইটি নাগপুর-এর মতো ভাল মানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা, এই সবের জন্যই সেখানকার মানুষ খুশি থাকবেন। মানুষ চাকরি না পেলেও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাপনা দেখে ভোট দেবেন— ভেবেছিলেন তাঁরা। কিন্তু না, কংগ্রেস আর এনসিপি-র আঞ্চলিক নেতারা এগিয়ে গেলেন ভোট-কর্মধারায়। বিদর্ভ অঞ্চলে আক্ষরিক ভাবে দোরে দোরে গিয়ে প্রচার করেছেন তাঁরা— যে প্রচারের কেন্দ্রে একটাই শব্দ: অর্থনীতি। ক্লিষ্ট বিদর্ভে এসে যে মোদীর মতো নেতাকে কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার গুণগান গাইতে হচ্ছে, এতেই যা বোঝার বুঝে নেওয়া দরকার, বলেছেন বিরোধীরা। এবং জিতেছেন, আগের বারের থেকে অনেক বেশি। মনে রাখতে হবে, ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে যদিও আসনের হিসেবে বিজেপির কোনও ক্ষতি হয়নি, ভোটমার্জিন কিন্তু সে বারও অনেকখানি কমেছিল, আর কংগ্রেসের ক্ষেত্রে মার্জিন বেড়েছিল।

দু’টি চরিত্রের আলাদা উল্লেখ দরকার—গোপালদাস আগরওয়াল, এবং নিতিন গডকড়ী। গোন্ডিয়ার কংগ্রেসি নেতা গোপালদাস আগরওয়াল ভোটের ঠিক মুখে, অক্টোবর মাসের গোড়ায়, দল পাল্টে বিজেপিতে গেলেন, এবং বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়ালেন। কংগ্রেসের হয়ে তাঁর জেতার সম্ভাবনা ছিল বলেই বিজেপি তাঁকে পত্রপাঠ টিকিট দিল। গোপালদাস কিন্তু নতুন দলকে ডোবালেন, হারলেন নির্দল প্রার্থীর কাছে। নিতিন গডকড়ী নাগপুরের জনপ্রিয় ভূমিপুত্র, বিজেপি হেভিওয়েট, এমনকি গত লোকসভা নির্বাচনে ফিসফিসে গুজব ছিল তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু/সুতরাং এ বার মহারাষ্ট্রে ভোটের প্রচারে আসার সুযোগই পেলেন না তিনি। মোদী ও শাহের চোখে তিনি এখন প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই পরিত্যাজ্য। অর্থাৎ ভোটে যে মানুষের মতামতের ছায়া পড়ে, আর তাই অঞ্চল-ভিত্তিতে তাঁদের পছন্দ-অপছন্দ ভাল-মন্দ বিচার করা দরকার— বিজেপি এই সামান্য সত্যটা ভুলে গিয়েছে পাঁচ বছরে। কারণ? একটাই। স্পর্ধা। শিবসেনা নেতৃত্ব যত সুযোগসন্ধানীই হোক, ফাটা রেকর্ডের মতো যে কথাটা তারা বলে আসছে, তাতে সত্যের পরিমাণ একশো ভাগ। অঞ্চলকে ভুলেছে বিজেপি। পওয়ার প্রমুখ আঞ্চলিক নেতারা ভোলেননি। এখানে একটা বার্তা আছে, যা পড়াটা অবশ্য সহজ নয়।

এই মুহূর্তে বার্তা পড়ার কঠিন কাজটা আরও একটি দলের করার কথা। এই ভোট দেখিয়ে দিয়েছে, বিদর্ভ অঞ্চলে কংগ্রেসের শিকড় কম শক্ত নয়। ২০০৯ সালে তারা এই অঞ্চলের অর্ধেক সংখ্যক আসনই একার ঝুলিতে পুরেছিল। ২০১৪ সালের বিধানসভা ভোটে ঝুলি ফুটো হয়ে কিছু আসন গলে যায়। কিন্তু সমর্থন যে ২০১৯ সালেও বেশ জোরদার, কোঙ্কণ অঞ্চলের সাড়ে চার শতাংশ ভোটের পাশে বিদর্ভে কংগ্রেসের ২৫.১৪ শতাংশ ভোট এবং পনেরোটি আসনই তা বলে দিচ্ছে। সনিয়া-রাহুলের মতো নেতারা এসে প্রচার করেননি, মনোযোগ দেননি, অঞ্চলের নেতাদের জোরেই যেটুকু যা ঘটার ঘটেছে, লোকসভা ভোটের প্যাটার্ন থেকে বহুলাংশে আলাদা হয়ে গিয়েছে বিধানসভার ভোট— এতে কিছু খবর লুকিয়ে আছে কি, খেয়াল করার মতো?

ভাবুক কংগ্রেস। ভাবুক আর সব বিরোধী দল এবং আঞ্চলিক দলগুলি। ভোট কেবলই কৌশল নয়, ভোটের পিছনে মানুষের কথা আছে, বাস্তবের জলহাওয়া আছে— ধাক্কা দিয়ে বলে গিয়েছে হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন