একটা সময় বাঙালির গর্ব করার বিষয় ছিল তার রাজনৈতিক বোধ। আমরা রাজনীতি সচেতন, সাম্প্রদায়িক নই, জাত-পাতের পরোয়া করি না, ইত্যাদি। অর্থাৎ আদর্শ গণতান্ত্রিক পরিবেশের জন্য যা যা অপরিহার্য, সেগুলো আমাদের ছিল। ছোটবেলায় মনে প্রশ্ন আসত, মানুষ রাজনীতি করে কেন? বড় হতে হতে আস্তে আস্তে জানতে পারলাম, জীবনের প্রতিটি পরতে জড়িয়ে রয়েছে রাজনীতি। তা সে দেশ শাসন হোক বা অর্থনীতি। শিক্ষার জগৎ বা খেলার জগৎ। রাজনীতি ছাড়া জীবন অচল। আরও বড় হয়ে খুঁজতে শুরু করলাম, আমি রাজনীতির কোন দিকে? একটা পুরনো গান বেশ পছন্দও হল, ‘‘আমি বাম দিকে রই না আমি ডান দিকে রই না/ দুই দিকেতেই রই পরান জলাঞ্জলি দিয়া রে।’’
তখন ট্রেনে-বাসের আড্ডায় সাবলীল ভাবে ঢুকে পড়ত রাজনীতির প্রাণবন্ত আলোচনা। সব সময়েই সাবলীল থাকত না অবশ্য। কখনও কখনও কথা বলার সময় সাবধানী হতে হত। এ দিক ও দিক দেখে তবে বলতে হত। প্রাণের কথাও বলতে গিয়ে ঢোঁক গিলে তৈরি কথা বলতে হত। এক বার আমার প্রিয় এক রাজনৈতিক নেতা একান্তে সস্নেহে বলেছিলেন, ‘‘পাবলিকলি এ কথাটা বলে ঠিক করোনি।’’ আমি আকাশ থেকে পড়েছিলাম, ‘‘আপনি জানলেন কী করে?’’ স্মিত হেসে উনি বললেন, ‘‘চব্বিশ ঘণ্টা রাজনীতি করছি আমরা, কিছু খবর তো থাকবেই ভাই।’’ অন্য দিকে যাঁরা স্পষ্টত এক পক্ষের, তাঁদের এ সব টানাপড়েন ছিল না। যাঁরা প্রকৃতিগত ভাবে সুযোগসন্ধানী, তাঁদেরও কোনও সমস্যা হত না। সমস্যা হত আমাদের মতো মাঝের মানুষদের। সব দিক সামলে চলতে হত। রাজনৈতিক দলের কর্মপদ্ধতি নিয়ে গভীর সব প্রশ্ন ছিল। মানুষের অভ্যন্তরীণ ভাবনার কাঠামো বদলের চেষ্টা না করে শুধু ওপর ওপর বদল কি সম্ভব?
এখন সেই সব প্রশ্নের দিন আর নেই। কর্মপদ্ধতি, অভ্যন্তরীণ ভাবনা ইত্যাদি রাজনীতির অঙ্গন থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। এখন স্পষ্ট, বাঙালি পাঠক বা শ্রোতা কেউই বস্তুমুখী সৎ খবর পছন্দ করেন না। মনোমতো খবর তাঁদের কাছে পৌঁছলেই তাঁরা খুশি। এমন খবর যা মনকে তৃপ্তি দেবে। আজকের পাঠক নিজের পছন্দের কাগজ থেকে নিজ মতাদর্শ সমর্থনের পাথেয় জোগাড় করে নেন। সংবাদপত্র গোষ্ঠীর ‘টার্গেট মার্কেটিং’ মডেলটা বেশ খাপ খায় এর সঙ্গে। এলাকার রাস্তা কেন খারাপ? উত্তর, হয় কেন্দ্রের বঞ্চনা বা রাজ্যের অপদার্থতা, যিনি যেটা শুনতে চান। কেন্দ্রের শাসকবিরোধী সর্বদা কেন্দ্রের দোষ দেখেন, রাজ্যের শাসকবিরোধীরা সর্বদা রাজ্যের ত্রুটি খুঁজে চলেন। অথচ রাস্তা খারাপ থাকার প্রকৃত কারণ হয়তো অন্য।
আশ্চর্যের বিষয়, আপাদমস্তক পক্ষপাতদুষ্ট সাধারণ মানুষের সমাজ এত বিশাল। এই বিশাল সংখ্যা নেহাত উপেক্ষার বস্তু নয়। এটা কি কাম্য? তাই কি এই রাজ্যে় যে কোনও বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, ধর্ষণ বা খুনের তদন্তে শেষ অবধি ন্যায়বিচার জোটে না, কেবল পক্ষপাতদুষ্ট চাপানউতোর চলতে থাকে, এবং শেষ পর্যন্ত উপসংহার যে কী হবে, সেটা প্রায় পূর্বনির্ধারিতই বলা চলে?
কোনও রাজনৈতিক দলের তাই আজ আর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। বাস্তব যে হেতু অস্পষ্ট, নীতি বস্তুটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো, আদর্শ কাকে বলে তাও কেউ ঠিকমতো জানে না, তাই রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের মতো করে এ সবের ব্যাখ্যা দিয়ে যায়, আর মানুষ পক্ষপাতদুষ্ট মনে কোনও রকম অগ্রপশ্চাৎ বিচার না করেই সে সব গ্রহণ করে। অপছন্দের তথ্যকে সন্দেহ করে, তাকে গুরুত্ব দেয় না, গ্রহণ করে না। আর পছন্দের মিথ্যাকে বিশ্বাস করে, উপরে তুলে ধরে। এই অতি-রাজনীতির জেরে সমাজের অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাকে কি দেশের জন্য মঙ্গলজনক বলা চলে? ভাল যদি সমর্থিত না হয়, খারাপ যদি ধিক্কৃত না হয়, তবে তা কি সমাজের জন্য ভাল হতে পারে? একটি আলোচনাসভায় ভারতের সংস্কৃতি প্রসঙ্গে বিবেকান্দের উক্তি ব্যবহার করেছিলাম। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকের সেই বক্তব্য মনোমতো হয়নি বলে় তিনি বললেন, ‘‘দেড়শো-দু’শো বছরের পুরনো রেফারেন্স আজ অচল।’’ তাই কি? মূল্যবোধের নতুন-পুরনো কি এতটাই আলাদা? না কি, পক্ষপাতের উপর নির্ভর করেই আমরা নতুন পুরনো বেছে নিই?
সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা বিশ্লেষণ ও সমাধানের জন্য পক্ষপাতশূন্য স্বচ্ছ চিন্তার যুক্তিবাদী মন প্রয়োজন। কিন্তু আগে থেকেই যাঁরা রাজনীতি, আর তার পছন্দমতো রাস্তা নিয়ে বসে আছেন, তাঁদের পক্ষে তো সমস্যাগুলোও ঠিক করে বোঝা সম্ভব নয়, সমাধান তো দূর অস্ত্।
আজ বাংলার রাজনীতির অভিধানে ‘মিথ্যা কথা’র পরিবর্তে প্রবেশ করতে পারে একটি নতুন শব্দ: ‘রাজনৈতিক কথা’। অর্থাৎ ডাহা মিথ্যা কথাও রাজনৈতিক হলে এখানে চলে যায়, চালানো যায়। রাজনীতিই যখন মুখ্য, সেখানে সত্য-মিথ্যার বাছবিচার দরকার কী। বরং সেই ফাঁকে স্বার্থ গুছিয়ে নেওয়াই বুদ্ধির কাজ়। সত্য বা সততা এখন বোকামির লক্ষণ। যে যত বুদ্ধিমান, সে তত মিথ্যা ও ভুলের প্রয়োজনমতো ব্যবহার করে স্বার্থের সিদ্ধি ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নেয়। আমরা সবাই জানি এবং মানি যে, কাল দুই পা এগোনোর জন্য আজ এক পা পেছোনই ঠিক কাজ।
ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী পাঁচ দশকের বেশি সময় বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘দলবিরোধী কাজের জন্য’ তাঁকে নাকি সাসপেন্ড করা হয়। তখন জেনেছিলাম ‘‘একমাত্র মৃত্যুর পরে জানা যায় কে প্রকৃত বামপন্থী।’’ কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যে, কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, সে সবই প্রেক্ষিতনির্ভর। সুতরাং এ পাপ কারও একার নয়, এ পাপ আমাদের সকলের।
অথচ যে কোনও সমাজের মতো বাঙালি সমাজেও বেশ কিছু মানুষ কাজ করতে ভালবাসেন, কাজ করে তৃপ্তি পান। এঁদের অনেকেরই জীবনবোধ বা রাজনীতিবোধ হয়তো তত স্পষ্ট নয়, কিন্তু এঁরা সকলেই জানেন, কাজের জন্য, জীবিকার জন্য প্রয়োজনে কিছু ছাড়তে হয়। এই মানুষগুলোকে রাজনীতি তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে শিখে গিয়েছে। শাসনের প্রতি স্তরে, সরকারি পদের নিয়োগে স্বজনপোষণ চালু করে এই রাজনীতি কাজের মানুষদেরও রাজনীতির মানুষ বানিয়ে নিয়েছে। কাজের স্বার্থে ও ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজের মানুষও ক্রমে ক্রমে শাসকের অনুগত হন। জীবনের স্বাভাবিক সুযোগসুবিধেগুলো পাওয়ার জন্যও শাসক দলের রাজনীতির আনুগত্য প্রকাশ করতে তাঁরা ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে যান। এই ভাবে যখন সাধারণ মানুষই রাজনৈতিক হয়ে পড়েন, তখন দেখা দেয় ়একটা নতুন সমস্যা। সরকার পরিবর্তন হয়ে নতুন সরকার এলে সেই সমস্যাটা স্পষ্ট হয়।
রাজনীতি এখন রোজ সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর, তাই নতুন শাসকরা অনেক সময়েই পুরনো কাজের লোকেদের গুরুত্ব দেন না। এর ফলে রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্র উপযুক্ত লোকের অভাবে ধুঁকতে থাকে। বর্তমানে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্র এই সমস্যার উজ্জ্বল উদাহরণ। স্কুল, কলেজ, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে উপযুক্ত ইচ্ছুক ব্যক্তির বিরাট অভাব চার দিকে। এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে দিনের পর দিন, দেশ ও সমাজের জন্য তা মোটেও হিতকর হতে পারে না়।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য থাকা জরুরি। যে ওষুধে রোগ নিরাময় হয়, তারই অতিরিক্ত সেবনে আবার হিতে বিপরীত হয়। দিন কয়েক আগে হোয়াটসআপে চাণক্যের নামে একটা উক্তি পেলাম: ‘‘যা কিছু মাত্রাতিরিক্ত তা-ই বিষ।’’ এই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা রাজনীতি বিষয়েও প্রাসঙ্গিক। সমগ্র জাতি যদি চব্বিশ ঘণ্টা ধর্মাচরণে ব্যস্ত থাকেন, তা হলে কিছু মানুষ হয়তো তৃপ্তি পাবেন, কিন্তু সার্বিক ভাবে তা দেশের পক্ষে কোনও ভাবেই শুভ হতে পারে না। দেশের সব মানুষ হিমালয় বা সাগর-অভিযানে মেতে উঠে বেরিয়ে পড়লে সেটাও দেশের পক্ষে সুখকর হবে না। একই কথা প্রযোজ্য রাজনীতির প্রসঙ্গেও।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক