গৌরী লঙ্কেশ এবং এম এম কলবুর্গীর।
সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ এবং স্বনামধন্য কন্নড় লেখক এম এম কলবুর্গীর হত্যার মধ্যে সাদৃশ্য শুধু এইটুকুতেই নহে যে তাঁহাদের দুই জনের হত্যাতেই হিন্দুত্ববাদীরা অভিযুক্ত। সাদৃশ্য আরও। দুই জনের নিধনে নাকি একই পিস্তল ব্যবহার হইয়াছিল, ফরেন্সিক রিপোর্ট উবাচ। ঠিক যেন গায়ে-কাঁটা দেওয়া অপরাধ-কাহিনি। ‘থ্রিলার’। প্রশ্ন ইহাই যে, বাস্তব অপরাধ যদি থ্রিলার-মাফিক হইতে পারে, তবে থ্রিলারকে অপরাধ-চিত্র দেখাইবার জন্য দোষারোপ করা যায় কি? ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা যে হত্যায় অভিযুক্ত তাহা যদি সস্তা অপরাধ-কাহিনির শৈলীকে অনুসরণ করে, তবে জনপ্রিয় টেলিভিশন থ্রিলারে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীকে দেখানো খুব অস্বাভাবিক কি? ‘হিন্দু জঙ্গি’ বলিয়া যদি কিছু না-ই থাকিত, তবে তো কলবুর্গী বা লঙ্কেশ আজও আমাদের মধ্যেই থাকিতেন। ঘটনা হইল, বর্তমান ভারত ইতিমধ্যেই হিন্দু জঙ্গিবাদের সহিত পরিচিত। অথচ বিশ্ব-রাজনীতি-ভাষ্যে ‘হিন্দু জঙ্গি’ কথাটি এখনও ততখানি প্রবেশ করে নাই। ফল? মার্কিন দেশের কোয়ান্টিকো সিরিয়ালে গোয়েন্দারূপী প্রিয়ঙ্কা চোপড়াকে হিন্দু জঙ্গি হানা বানচাল করিবার ভূমিকায় দেখিয়া খেপিয়াছে উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, এবং ক্ষমা চাহিয়াছে সিরিয়ালের নির্মাতা টিভি চ্যানেল।
বাস্তবিক, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য জনসংস্কৃতিতে সাম্প্রতিক হিন্দুত্ববাদী অসহনশীলতার চোট দেখিয়া আতঙ্কিত হইতে হয়। কিছু কাল আগেই পদ্মাবতী কল্পকাহিনির চলচ্চিত্রায়ণ লইয়া অসহনের তাণ্ডব ঘটিয়াছে। পাকিস্তানি অভিনেতাকে বলিউড ছাড়িতে হইয়াছে। পাকিস্তানি গায়কের অনুষ্ঠান বাতিল করিতে হইয়াছে। আমির খান ঘৃণিত হইয়াছেন, শাহরুখ খানকে ভারত-বিশ্বস্ততার পরীক্ষা দিতে হইয়াছে। লজ্জা রাখিবার স্থান এমনিতেই ছিল না। এই বার অসহনশীলতার ঔদ্ধত্য বিদেশি টেলিভিশন পর্যন্ত হানা দিয়া সেই লজ্জা গগনচুম্বী করিল। টুইটার আক্রমণের ভাষা ও ভাব বুঝাইয়া দিল, কতখানি মূর্খামি এই অসহনশীলতার পরতে পরতে ঠাসা। কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে ফারাক করিতে শিখে নাই এই অধৈর্য অত্যুগ্র জাতীয়তাবাদ। প্রিয়ঙ্কা চোপড়া পর্দায় হিন্দু জঙ্গি ধরিতেছেন মানেই তিনি নিশ্চয়ই হিন্দু ভারতের বিরুদ্ধে প্রচার করিতেছেন, এবং তাহা হইলে নির্ঘাত ওই ভয়ঙ্কর অভিপ্রায়েই তিনি মার্কিন দেশে পা রাখিয়াছেন! কুটিল কুযুক্তির এই বৃত্তে শুভবোধকে বাঁচাইয়া রাখা সত্যই অতি সুকঠিন।
মার্কিন-প্রবাসী ভারতীয় সমাজের একটি বড় অংশ চিরকালই অতিরক্ষণশীলতার ধ্বজাধারী। বর্ণবিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা চিরকাল এই গোষ্ঠীর বিশেষ প্রিয় মনোভাব। রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও তাহারা পরিচিত। বর্তমান বিজেপি শাসনের অসহিষ্ণুতম মুখটি একাধিক বার এই ‘ডায়াস্পোরা’ সমাজের ভিতরে প্রকাশিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ছিলেন, মুসলিমবিরোধিতার জন্য তিনি ভারতীয় সমাজের এই অংশটির উপর অকাতরে নির্ভর করিয়াছেন। তবে কি না, আজকাল প্রবাসী ও দেশি সমাজের দূরত্ব ক্রমেই অপস্রিয়মাণ: সোশ্যাল মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যমগুলির দৌলতে দেশবিদেশ ভাগাভাগি কমিতেছে, রক্ষণশীলতার নদী দরিয়ায় মিশিতেছে। আগে ঘরের কোণে দাঁতনখগুলি বাহির হইত। আজকাল হিংস্রতার চর্চা সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত বিস্তৃত। চিন্তা সেই কারণেই দ্বিগুণ।