কৃষি আমাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। কৃষি সমস্যা নিয়ে আমরা এর আগের পর্বে কিছু আলোচনা করেছি (‘কৃষিতে সমস্যা থাকলেই লাভ’, ৮-৮)। মনে রাখতে হবে, এ দিক ও দিক থেকে আমরা কিছু আমদানি করি বটে, কিন্তু দেশের ১৩০ কোটির মুখে অন্ন তুলে দেয় দেশের কৃষিজাত পণ্য। অথচ এটাই সব চেয়ে অবহেলিত ক্ষেত্র। সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষণমাত্র নেই— কোথায় কী করলে মরসুমের শেষে এক বস্তা ফুলকপি আর মাত্র দশ টাকায় বিক্রি করতে হবে না, তার সূত্র কেউ বলে দিতে পারেন না। দান–ধ্যানের রাজনীতি শুধু এই মুহূর্তে কী হচ্ছে, তা নিয়েই ব্যস্ত।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা রাজ্যে চুক্তিচাষের ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। সেই নীতি দলের অভ্যন্তরে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। কৃষকদের যত বেশি চুক্তিচাষের সুযোগ দেওয়া যায়, ততই মঙ্গল। কারণ কৃষকদের রোজগার বাড়ানোই লক্ষ্য হওয়া উচিত, রাজনীতির দয়াদাক্ষিণ্যপ্রসূত দানসত্র নয়। সরকারের উচিত, যাঁরা কৃষিজাত পণ্য বাজারে নিয়ে যাবেন, তাঁদের সঙ্গে কৃষকদের সম্পর্কের ওপর নজর রাখা। যে হেতু বাজারই বলতে পারে কখন কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, এবং প্রযুক্তি ও বাজারিকরণে দক্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সম্পর্কই কৃষকদের লাভবান করতে পারে, ফলে তা নিয়ে আলোচনা এবং সার্বিক উদ্যোগ বিশেষ প্রয়োজন। চুক্তি চাষের ফলে কৃষকদের লাভ-ক্ষতির হিসেবও বিশ্লেষণ করা উচিত। মুশকিল হল, বিষয়টা রাজনৈতিক ভাবে বেঠিক। ফলে, এ নিয়ে কথা বলার উপায় নেই।
প্রশ্ন হল, সরকার কি চাইবে কৃষকদের আর্থিক নির্বাণ লাভ? বামফ্রন্টের সময় যে সব নেতানেত্রী কৃষি আন্দোলনের নামে বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতার বৃত্তে ছিলেন, তাঁরা হয়তো চুক্তি চাষের প্রস্তাবে ভয় পেয়েছিলেন। এ কথা অনেকেই জানেন যে মানুষ বিত্তশালী হলে সরকারের ওপর তেমন নির্ভর করে না। অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসার ও ব্যাপ্তি কমে যায়। সর্বহারার আন্দোলন তেমন জুতসই হয় না। যে দেশে সরকার বা রাজনীতি দান-ধ্যান করে ক্ষমতায় থাকার শিক্ষায় অভ্যস্ত, সে দেশে দান-ধ্যান ছাড়া আর্থিক উন্নতিতে কেউ তেমন উৎসাহ পান না।
আমরা চাইব কৃষকদের প্রভূত মুনাফা বৃদ্ধি হোক, যাতে তাঁরা ধারদেনা শোধ করে দিতে পারেন। কৃষিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা নিজেদের পায়ে দাঁড়ান। কৃষিতে ভাল লাভ হলে মজুরিও বাড়বে। জোর করে মজুরি বাড়িয়ে দারিদ্র কমাবেন, ভাল কথা— কিন্তু, সেই নীতি ন্যায্য হয় যদি কৃষক উৎপাদক নিজে ১০০ টাকা লাভ করে মজুরকে কেবল ৫ টাকা দেন। কিন্তু কৃষক নিজেই ১০ টাকার বেশি লাভ করতে পারেন না কারণ সরকার মজুরি বাড়িয়ে ৫০ টাকা করে দিয়েছে— এ কথা লোককে না জানালে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়।
কৃষিতে কাজ করা, উদ্যোগ করা, নতুন প্রযুক্তি আনা— এগুলোকে কি আদৌ জাতীয় স্তরে আকর্ষক করে তোলা হচ্ছে? গ্রামে কৃষি মজুর আর্থিক ভাবে সচ্ছল হলে শ্রমের জোগান কমতে বাধ্য। এ ছাড়া, নতুন প্রজন্ম কৃষিতে কাজ করতে চান না। অনেকে পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলেন, কৃষিতে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি ভাল বর্ষা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভাব কৃষি উৎপাদনে খানিক বৃদ্ধি ঘটায় এবং একই সঙ্গে মজুরের জোগান কম হয়, তা হলে মজুর প্রতি উৎপাদন স্বভাবতই বেশি দেখাবে। এতে কর্মসংস্থান প্রকল্পের কোনও সদর্থক ভূমিকা আছে কি না, বোঝা যায় না। কোনও সরকারি প্রকল্পে শুধু ‘বরাদ্দ’ খরচ হচ্ছে কি না, সেটা একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না।কৃষক সমাবেশ, বিক্ষোভ, শস্যের দাম পর্যাপ্ত না হওয়া, ঋণভারে জর্জরিত হওয়ার সঙ্গে গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পের সম্পর্ক কী, তা নিয়ে সরকারি স্তরেই গবেষণা হওয়া উচিত। খেতে কাজ করার লোক না পাওয়া গেলে কৃষকদের সমস্যা অনেকটাই বেড়ে যায়। কিন্তু রাজনীতি এই কথায় কান দিতে চায় না। আর সরকার বাহাদুর দিতে পারলেই খুশি। মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াবে, এটাই সুচেতনার অঙ্গ। তাকে সারা জীবন পঙ্গু রেখে ক্রাচের ব্যবস্থা করা মানবিকতার মুখোশ পরে অমানবিক কাজ।
সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক
(শেষ)