Bardhaman

সহিষ্ণুতার বীজ বোনা হয়েছে প্রাচীন কালেই

রাজ প্রশাসনের আগে থেকেই একটি সংস্কৃতির ভিত্তি বর্ধমানের মাটিতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাতে আর্য-অনার্য, শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব ধর্মের সমন্বয় তৈরি হয়েছিল। তার উদাহরণ পাওয়া যায় এই এলাকার বিভিন্ন স্থানের নামকরণে। লিখছেন কবিতা মুখোপাধ্যায় বর্ধমান— এই নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে তার দু’টি রূপ— প্রাচীন বর্ধমান এবং রাজ আমলের বর্ধমান।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:৩৭
Share:

পীর বহরামের সমাধি। ফাইল ছবি

‘ধর্ম’ অর্থে ‘যা ধারণ করে’। সে যে ধর্মমতই হোক না কেন, তার প্রধান শক্তি হল সে পারে বহু মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখতে। কিন্তু তার শক্তি বিনষ্ট হয় রাজনীতির অনুপ্রবেশে। সমালোচকদের একাংশের মতে, সে অনুপ্রবেশ মাঝেমধ্যে ঘটে প্রশাসনের হাত ধরে। এ বিষয়ে, বর্ধমান এখনও ব্যতিক্রম। এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ডিএনএ-তে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এখনও প্রবেশ করতে পারেনি। কারণ, সেই প্রাচীন কাল থেকে আজ পর্যন্ত তেমন কোনও ঘটনা এখানে ঘটেনি, যাতে সাম্প্রদায়িক সহিষ্ণুতার পরিবেশ ক্ষুণ্ণ হয়। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধীর হত্যার পরে যদিও কিছুটা অসহিষ্ণুতার প্রকাশ দেখা গিয়েছিল।

Advertisement

বর্ধমান— এই নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসে তার দু’টি রূপ— প্রাচীন বর্ধমান এবং রাজ আমলের বর্ধমান। ‘প্রাচীন বর্ধমান’ বলতে যেটা বোঝানো হয়েছে, তার সঙ্গে বর্তমান বর্ধমানের ভৌগলিক পরিধির কোনও মিল নেই। প্রাচীন বর্ধমানের পরিধি কতটা ছিল তার সীমারেখা সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে প্রাচীন বর্ধমানের একটা ভৌগলিক সীমারেখার হদিশ পাওয়া যায় ষোড়শ শতকে রচিত ‘দ্বিগ্বজয় প্রকাশ’ নামে গ্রন্থে। সেখানে রয়েছে, অজয়, গঙ্গা, দামোদর বেষ্টিত ভূ-ভাগের কথা। এই বর্ণনা অনুসারে জানা যায়, বর্ধমানের মধ্য ভাগে রয়েছে দামোদর নদী (এখানে ‘নদ’ বলে উল্লিখিত হয়নি)। কিন্তু এখন যে শহরের নাম বর্ধমান সেখানে দামোদর নয়, বাঁকা নদীর পাশে রয়েছে শহর। বর্ধমান শহর এবং জেলার বেশির ভাগ পরিকাঠামো কিন্তু তৈরি হয়েছে রাজ আমলে।

বর্ধমানে বহিরাগত এই রাজপরিবারের ছত্রছায়ায় যেমন রাজনৈতিক হিংসা বা হানাহানি ঘটেনি, তেমনই ধর্মীয় বিদ্বেষও কোনও দিন মাথা চাড়া দিতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় রাজ পরিবারের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।

Advertisement

আসলে বর্ধমানের মাটিতেই রয়েছে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ। তার কারণ, বোধ হয়, এখানকার জনবিন্যাস এবং ধর্মীয় ভাবাবেগ। এখানকার আদি অধিবাসী হলেন বাগদি, বাউড়ি, কোল, মল্ল, গোপ-এবং আরও অন্য অনেক জাতি। এঁদের সরল জীবনযাপনকে ঘিরে ছিল ভাদু, টুসুর মতো লৌকিক দেবদেবী। এঁদের পুজোর মধ্যেও থাকত সব সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে একটি মিলনের সুর। তেমন ভাবেই পরে সত্যপীরের উরস বা শীতলা পুজোও ছিল সর্বস্তরের মানুষের একত্রিত হওয়ার দিন। এর মধ্যেই বিভাজন ও বিদ্বেষের কোনও জায়গা ছিল না। এই যে লৌকিক দেবদেবীদের পুজো, তাকে ঘিরে বসত মেলা। পালাগান শুনতে রাতের পর রাত জাগতেন সর্বস্তরের মানুষ। সে ধর্মবিশ্বাসে শৈব না শাক্ত, নাকি বৈষ্ণব তা কেউ কোনও দিনই কাউকে জিজ্ঞেস করেনি। এই বীজই রয়ে গিয়েছে এখানকার সংস্কৃতির রক্তে। তা ছাড়া সুফি ভাবনারও এক গভীর ছাপ রয়েছে এখানকার ধর্মাচরণের মধ্যে। বিশেষত, যে রাজপরিবারটি ছিল এখানকার শাসনক্ষমতায়, তাঁদের মধ্যে অনেকের মধ্যে ছিল সুফি সাধনার প্রভাব।

খ্রিস্টিয় অষ্টম শতকে ভারতবর্ষে প্রবেশ ঘটে সুফি ভাবধারার। ইরাক, পারস্য-সহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলি হয়ে সুফি সাধকেরা প্রবেশ করেন ভারতবর্ষে। এবং তাঁরা ছড়িয়ে যান বিভিন্ন প্রান্তে। বর্ধমানে সুদূর কাবুল থেকে আসেন খোক্কর সাহেব। জানা যায়, তিনি ফোর্টের কাছে আস্তানা তৈরি করেন। এবং সেখানেই তাঁর দেহ সমাধিস্থ করা হয়। পরে বর্ধমানের মহতাব মঞ্জিল তৈরির সময়ে উঁচু প্রাচীর দিয়ে খোক্কর সাহেবের সমাধিস্থলটি ঘিরে দেওয়া হয়। খোক্কর সাহেবের এই মাজার হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পবিত্র স্থান। খোক্কর সাহেবের পরে ১৫৫২ সালে পারস্য থেকে ধর্মপ্রচারে আসেন সুফি সাধক বহরাম শিক্কা বা সক্কা। বর্ধমানে এসে পুরতান চক এলাকায় যোগী জয়পালের আস্তানায় আশ্রয় পান। যোগী জয়পাল তাঁর অনুরক্ত হন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। বর্ধমানের মানুষের কাছে পীর বহরাম অন্যতম পবিত্র হিসেবে গণ্য করা করা হয়।

আসলে বর্ধমানে দেখা যায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের এক সহাবস্থান। হিন্দু-মুসলমান, শিখ-জৈন, বাঙালি-অবাঙালি মানুষের এক মিশ্র চরিত্র আর এই নানা ধর্মীয় মত অনুসারে মানুষের মধ্যে এক সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা করে চলতেন এখানকার প্রশাসকেরা। লাহৌর থেকে আসা অবাঙালি রাজপরিবারের রাজারা সব সময়েই চেষ্টা করতেন ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বাতাবরণ বজায় রাখতে। তাঁরা কখনই তাঁদের ধর্মমতকে অপরের উপরে চাপিয়ে দিতে তৎপর হননি। তাই মন্দির, মসজিদ, গুরুদ্বার, সবার অবস্থান রয়েছে সগৌরবে। একই সঙ্গে মানুষের মনের সঙ্কীর্ণতাকে দূর করার লক্ষ্যে প্রশাসনের উদ্যোগে শুরু হয়েছিল শিক্ষা প্রসারের কাজ। রাজ পরিবারের আনুকূল্যে এক দিকে যেমন, ইংরেজি শিক্ষা প্রসারের জন্য স্থাপিত হয়েছে নানা প্রতিষ্ঠান, তেমনই বহু সংস্কৃত টোল, মাদ্রাসা, স্কুলও পেয়েছে রাজ পৃষ্ঠপোষকতা।

প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই রাজপরিবার ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও ঐক্যকে বজায় রাখার জন্য এমন কিছু ঐতিহ্য গড়ে তোলেন যা আজও প্রাসঙ্গিক। রাজ পরিবার লাহৌরবাসী হলেও স্থানীয় নানা পুজো উৎসবে যোগ দিতেন, আবার মহরমের তাজিয়াও বার করতেন। কুরবানির সময় রাজস্থান থেকে উট আনিয়ে দিতেন রাজবাড়ির সদস্যেরা। শুধু তাই নয়, হিন্দু-মুসলমান— এক কথায় সব ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদেরকে তুলে ধরার জন্য তাঁরা হিন্দু টুপির পরিবর্তে ব্যবহার করতেন ‘বর্ধমান ক্যাপ’। এমনকি, তাঁদের প্রতীক, যা তাঁরা ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে পেয়েছিলেন, সেখানেও রয়েছে ধর্মীয় সমন্বয়ের মন্ত্র — তলোয়ার, ঢাল এবং অর্ধচন্দ্র। রাজপদবিতে চন্দ ও মহতাব সংযোজনকেই এক ধরনের সচেতন প্রয়াস বলে মনে করা হয়।

রাজ প্রশাসনের আগে থেকেই একটি সংস্কৃতির ভিত্তি বর্ধমানের মাটিতে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাতে আর্য-অনার্য, শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব ধর্মের সমন্বয় তৈরি হয়েছিল। তার উদাহরণ পাওয়া যায় এই এলাকার বিভিন্ন স্থানের নামকরণে। পরে রাজপরিবার এবং স্থানীয় সামন্তদের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই সংস্কৃতির প্রচার ও বিস্তার ঘটে। আধুনিকতার শিক্ষা পাওয়ার পরে গণতান্ত্রিক বর্ধমানের মানুষও সচেতন থেকেছেন যাতে এখানে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এ বার এই কাজের উত্তরাধিকার অর্পিত হয়েছে বর্তমান প্রজন্মের হাতে। আশা করা যায়, তারা এই ঐতিহ্যকে আরও সুদূরপ্রসারী করবে।

বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন