প্রবন্ধ ১

বাঁচি, বাঁচাই

‘দুধে ভাতে’ বাঁচুক আম দর্শক; জাঙ্কফুড দিয়ে বা খেয়ে খিদে মেরে দেবেন না। নইলে পরের প্রজন্ম মিউজিয়মে গিয়ে বাংলা সিনেমার কঙ্কাল দেখবে।

Advertisement

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share:

‘দুধে ভাতে’ বাঁচুক আম দর্শক; জাঙ্কফুড দিয়ে বা খেয়ে খিদে মেরে দেবেন না। নইলে পরের প্রজন্ম মিউজিয়মে গিয়ে বাংলা সিনেমার কঙ্কাল দেখবে।

Advertisement

র বীন্দ্রনাথকে প্রত্যেক বাঙালি নিজের পূর্বপুরুষ মনে করে। তাই, ঠাকুর দেবতার, বাবা মায়ের ছবি দেওয়ালে টাঙানো না থাকলেও একফালি গুরুদেব ঝুলিয়ে রাখতেই হয়। জন্মদিন থেকে শেষ যাত্রার ‘আগুনের পরশমণি’ পর্যন্ত রবীন্দ্রচর্চার মুক্তি নেই। যে কোনও সভাসমিতি, পূজা, প্রেম, বিচ্ছেদ, মেলা বা রাস্তার মোড়ে মোড়ে আমরা রবিমুগ্ধ। অথচ আমাদের জীবনযাপন বা শিল্পবোধে তার গভীর কোনও ভ্রুক্ষেপ টের পাই না। সন্ধে হলেই দেবী-দেবতা, সাপ-ব্যাঙের মধ্যযুগের গল্প, নয়তো গৃহস্থ বাড়ির কেচ্ছা উপাখ্যান দেখতে ড্রইং রুমে বসে পড়ি। শিব-দুর্গার প্রেমালাপ, জোড়া সাধকের লড়াই বা সুন্দরী মেয়ের সাপ-সাপ ভাব— সব আমরা গিলছি। আশি শতাংশ বঙ্গবাসী এতেই মজে আছেন এবং তা লাভজনক বলে দেদার নির্মাণও হচ্ছে অলৌকিক বা পুরাণের গল্পবলা ধারাবাহিক। লাভ হচ্ছে অর্থে, কিন্তু পরমার্থে আমরা দিন-দিন রিক্ত হয়ে যাচ্ছি। যে কোনও শিল্পমাধ্যমেই ‘জনপ্রিয়’ হয়ে থাকার মশলা হয়ে দাঁড়িয়েছে পিছনে হাঁটা। বাংলা নাকি সংস্কৃতির পীঠস্থান! তার কোন নিদর্শন দিচ্ছি আমরা?

কথায়, ভাষায়, পোশাকে, জীবনযাপনে এ কোন বাঙালি অভিষিক্ত হচ্ছে! রবীন্দ্রনাথ যেন ‘স্মোকিং কিল্‌স’ মার্কা সতর্কবাণী; ক্যানসারের ভয়ে ভীত হওয়ার কোনও লক্ষণ কারও মধ্যে নেই। তুমুল বিক্রি হচ্ছে মৃত্যুর পাঁচন। দিন-দিন যেন মরিয়া হয়ে একটা প্রজাতি চিত হয়ে, চোখ বুজে ‘আগুনের পরশমণি’ শোনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে! আমি ভীত! আমি লজ্জিত! তাই যখন সংস্কৃতির আদিখ্যেতা, বার্গম্যান, পাসোলিনি, ওয়াং কার ওয়াই-এর পাশাপাশি গ্যাদগেদে বা চড়া দাগের কোনও কাজ নিয়ে বাঙালিকে বিহ্বল হতে দেখি, তখন মনে হয়, যা আমাদের আসলে প্রাপ্য, আমরা তা-ই বেছে খাচ্ছি।

Advertisement

শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন নাটক দেখো, ‘ওতে লোকশিক্ষে হয়!’ এত বড় প্রশংসা গিরিশ ঘোষ কোনও দিন পাননি, পাশাপাশি এত ভারী দায় তাঁর ঘাড়ে কোনও দিন কেউ চাপিয়ে দেয়নি। আমি সিনেমাওয়ালা। ছবি বানিয়ে, ফেরি করে হলে হলে বিক্রি করাই আমার পেশা। ওই ‘লোকশিক্ষে’র দায়ভার যদি আমি বা আমরা এড়িয়ে যাই, তবে বড় মর্মান্তিক পরিণতি হবে। এমন কিছু আমরা বিক্রির দোহাই দিয়ে বানাতে পারি না, যা আমাদের জীবনকে খুঁজে দেয় না, বা একটিও আশার কথা, বাঁচার কথা বলে না। আমরা সমাজ সংস্কারক নই, আবার কেবলমাত্র ব্যবসায়ীও নই। ‘মানুষ খাবে’ বলে তাকে এমন কিছু খাওয়াতে পারি না, বা পরিবেশন করতে পারি না, যাতে একশো বছর পিছনে হাঁটতে হয় সভ্যতাকে। অমন লাভের মরণ হোক।

বাংলার মানুষের জনপ্রিয় ধারার ছবি ছিল হারানো সুর, সপ্তপদী, নিশিপদ্ম, গল্প হলেও সত্যি, অমানুষ, সিস্টার, লালকুঠি-র মতো সিনেমাগুলি। সেখানে এক পলকের জন্যও বাংলার বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেতে, বাংলার শিক্ষার ও সৌজন্যবোধের নিদর্শন পেতে বেগ পেতে হয়নি। তার পর থেকে আজ পর্যন্ত জনপ্রিয় মূলধারার ছবির এমন ভাষাবিভ্রাট ঘটল যে, বঙ্গভূমির ধানখেতে ভুট্টা ফলতে শুরু করল, বাড়ির সাজগোজ গেল বদলে, কাচ বসানো ঝলমলে চড়া রঙের শাড়িতে আঁচলগুলো ধারালো হয়ে উঠল! পুরুষদের ধুতিপাঞ্জাবি উধাও হয়ে চুড়িদার জুটল, গলায় পশ্চিম ভারত থেকে উড়ে এসে ফাঁসের মতো বসল ওড়না! ভাষায় অদ্ভুত সংকর শব্দবন্ধনী তৈরি হল, যা অচেনা!

আমাদের সিনেমাতেও এই অসৌজন্যের ছাপ পড়তে থেকেছে ও আমাদের শিকড় ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে! আজ তা সামান্য ঝড়ে মাথা তুলে রাখতে পারছে না। এ রকম এক অবস্থায় অপ্রিয় কথাগুলি কারও উঠে দাঁড়িয়ে বলার দরকার ছিল, আমি আমার মতো করে প্রকাশ করছি। আমরা আজকাল শুনে থাকি, গ্রাম নাকি একটু গোদা সিনেমা খায় ভাল। অথচ ভুলে যাই আজকের প্রজন্মের পূর্বপুরুষরা যে মূলধারার ছবি দেখত, তাদের কথা। তেমন কয়েকটা নাম তো লিখলাম! মাঝে কী এমন ঘটল যে বংশধরদের রুচি বেবাক বিগড়ে গেল! গ্রামে ও ছোট শহরে দীর্ঘদিন ধরে যে সিনেমা পৌঁছে দিয়ে চলেছি, তাতে লাভের লাভ বাংলার মানুষের হয়নি। হাওয়ার টানে গা ভাসিয়েছি আমরা। পাল ঘুরিয়ে, দাঁড় আঁকড়ে দিক ঠিক করিনি নৌকার! তাই আজ বাংলায় ৭০০টি সিনেমা হল কমে ২৪৮টিতে ঠেকেছে!

মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছে বাংলার সিনেমা হলগুলো আর আমরা আধুনিক প্রযুক্তির ধোঁয়া তুলে আসল ত্রুটিগুলো ঝাপসা করে রাখছি। বার বার ভুলে যাচ্ছি সংস্কৃতির পীঠস্থান শহর নয়। ছোট ছোট শহরতলি, গ্রামে কী প্রচণ্ড অহংকার ও আবেগ নিয়ে শিল্পচর্চা হচ্ছে আজও! বিশ্ব চলচ্চিত্র, সাহিত্যের সঙ্গে তাদের রোজকার যোগ অনেক বেশি। তাদের আরও কত দিন ‘অলীক কুনাট্য রঙ্গে’ আটকে রাখব? রাখতে পারছি না বলেই আজ এত সিনেমা ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা আমায় বিরাট ভাবে উজ্জীবিত করছে। মানুষ জেগে, ঘুমোয়নি ওরা। শহরের দর্শক যারা, তারা বড় ব্যস্ত! সব কাজ সামলে, কাগজে সমালোচনা পড়ে, অন্তত দুজন বন্ধুর মুখে বাহবা শুনে তবেই সিনেমা হলে যান! অথবা যখন আঁচ করেন এ ছবির মার খাওয়ার কোনও চান্স নেই, তখন সাহস করে চলে আসেন হলে। তখন আমরা কিছু হিট, সুপারহিট পেয়ে যাই!

অথচ দক্ষিণ ভারতে বা মহারাষ্ট্রে ওদের নিজেদের আঞ্চলিক সিনেমা মাথার ঘাম ফেলিয়ে ছেড়েছে হিন্দি সিনেমাওয়ালাদের। ওখানকার মানুষ জীবনযাপনের অঙ্গ হিসেবে সিনেমাকে স্থান দিয়েছে। নিয়ম করে তাঁরা হলে গিয়ে ছবি দেখছেন। কোটি কোটি টাকার লাভ হচ্ছে সেখানে এবং সেই সব ছবি তাঁদের নিজেদের সংস্কৃতি, সভ্যতার সব চরিত্র বজায় রেখেই তৈরি হচ্ছে। জাতহীন কোনও প্যাকেজিং-এর ফাঁদে দর্শককে ফাঁসানোর চালাকি করেন না ওঁরা। কেন আমরা পারছি না? কেন পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে শুধু রুগ্ণ চলচ্চিত্র শিল্পের আলোচনা হবে? কোথায় গেল আমাদের অহংকার? কেন দর্শক নিজের অভ্যেসের মধ্যে সিনেমাকে স্থান দিচ্ছেন না! সিনেমাওয়ালারা বাংলার শিকড় আঁকড়ে ধরুন, দর্শক দু’হাতে আলিঙ্গন করুন মাতৃভাষার চলচ্চিত্রকে! নিজেদের শিল্পকে বাঁচাতে আমাদেরই তো হবে। রবীন্দ্র-রাংতায় বেশি দিন আর টানা যাবে না কালচারাল ভাবমূর্তিকে! সৎ হোন দুই পক্ষই— দর্শক ও সিনেমাওয়ালারা।

আমরা যারা শহুরে সিনেমাওয়ালা, দীর্ঘ লড়াইয়ের পর আজ তাঁদের পায়ের তলায় মাটি ঠেকেছে। বেশ কয়েকটি দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য আরও শক্ত করছে, বিস্তার করছে তার বিচরণভূমি। তবে ত্রিশ-চল্লিশটা হল থেকে একশো হলে পৌঁছতে আমাদের বেশ কয়েকটা চাঁদের পাহাড়, বেলাশেষে, প্রাক্তন, মিশর রহস্য বা শব্দ লাগবে। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি বাংলা ছবি ও সংস্কৃতির জন্য আমাদের ভাগের কাজটুকু করতে। বাকিরা বাকি ২০০টা হলের কথা ভাবুন। ওইখানে চেয়ে আছে লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত দর্শক! যে খাদ্য স্বাস্থ্যসম্মত, তা-ই পরিবেশন করুন। ‘দুধে ভাতেই’ বাঁচুক বাংলার আম দর্শক; ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড দিয়ে বা খেয়ে খিদে মেরে দেবেন না। এই দায়িত্ব সকলের। নইলে পরের প্রজন্ম কেবলমাত্র মিউজিয়মে গিয়ে বাংলা সিনেমার কঙ্কাল দেখবে। এক সিনেমাওয়ালার অনুরোধ এটা মাত্র।

লেখকের পরিচালনায় তৈরি ‘সিনেমাওয়ালা’ ছবির একটি দৃশ্য

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement