সদ্য-প্রয়াত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়াম হকিং কৌতুকের সহিত এই তথ্য পরিবেশন করিতেন যে, তাঁহার জন্ম-তারিখ গালিলেও গালিলেইয়ের মৃত্যুর ঠিক তিনশো বৎসর পরে। হকিংয়ের অতি বিখ্যাত পুস্তক আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম-এর পরিশেষে তিন বিজ্ঞানীর স্বল্প দৈর্ঘ্যের জীবনী রহিয়াছে। উক্ত তিন জন হইলেন আলবার্ট আইনস্টাইন, গালিলেও এবং আইজাক নিউটন। কেহ কেহ ইহার মধ্যে হকিংয়ের একটি সুপ্ত বাসনার গন্ধও পাইয়াছিলেন। হকিং নাকি নিজেকে ওই তিন বিজ্ঞানীর উত্তরাধিকারী হিসাবে জাহির করিতে চাহিয়াছিলেন। তবে, অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই, জনপ্রিয়তায় এক কালে যেমন আইনস্টাইন শিখরে আরোহণ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ খ্যাতি লাভ হকিংয়ের পক্ষে সম্ভব হইয়াছিল। আইনস্টাইনের পরে তিনিই আধুনিক বিজ্ঞানের মহাতারকা হিসাবে গণ্য হইয়াছিলেন। এই মূল্যায়ন জনমানসের ব্যাপার। গবেষকগণ জানেন যে, আরও একটি অভীপ্সায় হকিং সত্যই আইনস্টাইনের উত্তরসূরি ছিলেন। আকাঙ্ক্ষাটি হইল: ব্রহ্মাণ্ডের এক ও অদ্বিতীয় সূত্র আবিষ্কার।
বিজ্ঞানীরা ব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ ক্রিয়াবিক্রিয়াকে মোট চারিটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। এক, মহাকর্ষ, যাহার অর্থ সুপরিচিত। দুই, তড়িৎচুম্বকীয় বল, যাহার ক্রিয়ায় সমস্ত বৈদ্যুতিন যন্ত্র কাজ করে। তিন, দৃঢ় বল, যাহার প্রভাবে পরমাণুর মধ্যে নিউক্লিয়াস অটুট থাকে। এবং চার, মৃদু বল, যাহা তেজস্ক্রিয়তার মূলে দায়ী। এই চারিটি বলের মধ্যে মহাকর্ষ বাদে বাকি তিনটিই পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম মেকানিক্স শাস্ত্রের মধ্যে পড়ে। আইনস্টাইন প্রমাণ করিতে চাহিয়াছিলেন যে, ব্রহ্মাণ্ড ব্যাপিয়া একটিমাত্র নিয়মের অনুশাসন চালু আছে। আইনস্টাইন জানিতে পারেন নাই, ব্রহ্মাণ্ডে চারি প্রকার বলের খেলা চলিতেছে। তাঁহার জীবৎকালে মাত্র দুইটি বলের কথা জানা ছিল: মহাকর্ষ ও তড়িৎচুম্বকীয় বল। মহাকর্ষ ব্যাখ্যায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদই যথেষ্ট। তিনি চেষ্টা করিয়াছিলেন এমন একটি সূত্র আবিষ্কার করিতে, যাহা মহাকর্ষ এবং তড়িৎচুম্বকীয় বলকে ব্যাখ্যা করিবে। সেই চেষ্টায় তিনি সফল হন নাই। আইনস্টাইনের প্রয়াণের পর বলের সংখ্যা চারিটি আবিষ্কৃত হইলে গবেষকগণ ওই চারিটিকে একটিমাত্র সূত্রে (‘থিয়োরি অব এভরিথিং’) ব্যাখ্যা করিবার প্রয়াসে রত হন। এই প্রচেষ্টা যাঁহাদের ঐকান্তিক স্বপ্ন, তাঁহাদের মধ্যে হকিং অগ্রগণ্য।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজের লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে বৃত হইবার পরে প্রদত্ত ভাষণে স্টিফেন হকিং ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, তাঁহার জীবদ্দশায় থিয়োরি অব এভরিথিং আবিষ্কৃত হইবে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হকিং নিজে জানিতেন না তাঁহার পরমায়ু আর কত দিন। হকিং আশা করিয়াছিলেন বিজ্ঞানীগণ সূত্রটি আবিষ্কার করিবেন কিছু কালের মধ্যেই। হকিং দ্রুত প্রয়াত হন নাই, এবং থিয়োরি অব এভরিথিং আবিষ্কারের সময়সীমাও হকিং মাঝে-মাঝেই বাড়াইয়া দিয়াছেন। কখনও বলিয়াছেন ওই তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইবে ২০০০ সাল নাগাদ, কখনও বলিয়াছেন তত্ত্বটি হস্তগত হইবে ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে। ইহা আশাই হউক, অথবা ভবিষ্যদ্বাণীই হউক, প্রয়াণের পূর্বে হকিং যে থিয়োরি অব এভরিথিং-এর আবিষ্কার জানিয়া গেলেন না, ইহাই পরিতাপের বিষয়।