প্রজা শব্দটি রবীন্দ্রনাথের লেখায় নানা অর্থে ফিরে ফিরে আসে। প্রজাতন্ত্র বলি যখন তখন তো নির্জীব অন্যের মতে তাল মেলানো প্রজার কথা শুধু বলি না, প্রজার হাতে তন্ত্র অর্থাৎ সামর্থ ও অধিকার থাকবে, সে কথাও বলি। রবীন্দ্রনাথ প্রজা বলতে তেমনই জনসমূহকে বোঝাচ্ছিলেন। আত্মশক্তিপরায়ণ সামর্থবান সমূহকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন তিনি। আত্মশক্তি মানে তো নিজের বল, নিজের অধিকার সম্বন্ধে সজাগ ও সচেতন হওয়া চাই, নিজের মতো ভাবা চাই। ব্যক্তি তেমন সজাগ-সচেতন হলেই তবে সামূহিক ভাবে প্রজা হওয়া যাবে। প্রজার অধিকার আদায় ও দাবি করা যাবে। ব্যক্তিগত ভাবে শক্তিহীন হলে নিজের অধিকারের বোধ না জাগলে দলবদ্ধ হয়ে তো তা আদায় করা যাবে না।
সমূহ ব্যক্তির ঐকান্তিক বোধশক্তিহীন হলে তা ভয়ঙ্কর জনসমূহ হয়ে ওঠে। তাকে রাজা ও দেশনায়কেরা ইচ্ছেমতো যে দিকে খুশি চালিত করতে পারে। রাজতন্ত্র হোক কিংবা আধুনিক নেশনতন্ত্র অনুগত প্রজা অথবা নাগরিক চান রাজা ও নায়কেরা। তা হলেই তো পোয়াবারো। দেশের নামে এক দিকে চালানো যাবে তাঁদের। যেমন, স্বৈরতান্ত্রিক শাসকেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশের নামে লড়াই-খ্যাপা সমূহকে কাজে লাগিয়েছিলেন তেমনই আর কী। এখানেই রবীন্দ্রনাথের ভয়, আপত্তি। প্রজারা যেন আত্মশক্তিহীন না হয়ে ওঠে, প্রজা নামক সমূহের গড্ডল হয়ে উঠলে রাজতন্ত্র বা নেশনতন্ত্র কায়েম হয়, প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয় না। প্রজাতন্ত্রে ব্যক্তির ইচ্ছে-অনিচ্ছে প্রকাশিত হওয়ার কথা, সেই ইচ্ছে-অনিচ্ছের সঙ্গে বোঝাপড়ায় সমূহের নীতি স্থির হওয়ার কথা। সেটা যেন হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই গানে লেখেন ‘আমরা সবাই রাজা’। তাঁর মনে হয়েছিল পুরনো ভারতে আধুনিক নেশন ও নেশনের সংলগ্ন পাবলিক ছিল না বটে তবে নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতন প্রজাপুঞ্জ ছিলেন। তাঁরা রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে সামাজিক ইতিহাসের কাছাকাছি থাকা মানুষ। রাজা আসতেন, যেতেন। প্রজাসমাজ তাঁদের নিজেদের ভাল থাকার জন্য সচেতন ভাবে সামাজিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ভারতে ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাস আলোচনা করলে এমন প্রজা-সমাজের নিদর্শন পাওয়া যাবে। এমন প্রজার স্বরাজ পুরনো ভারতে ছিল কি না, কতটা ছিল, অথবা এ রবীন্দ্রনাথের আদর্শ কল্পনা কি না সে বিচার আপাতত থাক। তবে প্রজার ধারণা রবীন্দ্রনাথের কাছে সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক নয়। রাষ্ট্রের মহিমা প্রজার মহিমাকে খর্ব করতে পারে না। সে কথা তিনি পাব্লিক শব্দটির বিচার করতে গিয়ে খানিকটা লিখেছিলেন।
লিখেছিলেন, ‘সম্প্রতি এই গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজের কিছু রূপান্তর ঘটিয়াছে। ইহার মধ্যে একটা নূতন বন্যার জল প্রবেশ করিয়াছে। তাহার নাম পাব্লিক।’ এই পাব্লিকের গাঁই গোত্র আর একটু বিস্তারে লিখেছিলেন ‘জাভা যাত্রীর পত্র’-এ। ‘এখনকার পাবলিক একটা বিশেষ কালের দানাবাঁধা সর্বসাধারণ। তার মধ্যে খুব নিরেট হয়ে তাল-পাকিয়ে আছে এখনকার কালের রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি, এখনকার কালের বিশেষ রুচি প্রবৃত্তি এবং আরো কত কী। এই সর্বসাধারণ যে মানবসাধারণের প্রতিরূপ, তা বলা চলবে না।’ পাব্লিক শব্দটি রবীন্দ্রনাথের মতে ‘এখনকার কালের’ বা ‘বিশেষ কালের’। অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে ‘অ্যা মডার্ন’ বাংলায় যাকে ‘আধুনিক’ বলে এ হল তার সঙ্গে সম্পর্কিত। চতুর্দশ শতকের পর ইংল্যান্ডে ‘পাব্লিক’ বলতে প্রাপ্ত বয়স্কদের বোঝায়, কত বছরে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয় তা নিয়ে দেশে-কালে নানা হের-ফের। আবার পঞ্চদশ শতক থেকে ‘পাব্লিক’ বলতে সকলের জন্য উন্মুক্ত পরিসরকে বোঝায়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্লেষণে দু’টি অর্থকেই গ্রহণ করেছেন। তাই তাঁর মন্তব্য, পাব্লিকের বিপরীত শব্দ প্রাইভেট। রাষ্ট্রনীতি, ধর্মনীতি ও সমাজনীতিতে প্রাপ্তবয়স্কদের সকলেরই অংশগ্রহণের অধিকার অবশ্য একদিনে একই সময়ে খোদ ব্রিটেনে আসেনি, শুধু ব্রিটেন কেন, কোনও নেশনেই তা আসেনি। পুরুষদের মধ্যে কারা ভোটাধিকার পাবেন তার নানা শর্ত। ক্রমে ক্রমে ভোটাধিকার পুরুষদের মধ্যে ব্যাপ্তি পেয়েছিল, মেয়েদের ভোটাধিকার প্রাপ্তি পুরুষদের পরে। নেশনের নির্মাণ ও নেশনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে ‘পাব্লিক’-এর যোগ রয়েছে। নেশনের মধ্যস্থিত অধিকার অসচেতন ব্যক্তি বা সমূহ কিন্তু পাব্লিক-এর অন্তর্গত নন। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্মীয় অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলে ও নেশনের আওতায় বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তা লাভ করার চেষ্টা করলে জনসমূহ ক্রমে পাব্লিক পদবাচ্য হয়ে ওঠেন। বিলেতে উনিশ-বিশ শতকে এই পাব্লিক, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বন্যা স্বরূপ; অধিকারকামী ও অধিকার আদায়ে পারঙ্গম। রবীন্দ্রনাথের সময় সেই শব্দ ও বোধের ঢেউ ভারতে এসে লেগেছে। তবে রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, ভারতীয় জনগণ তখনও পাব্লিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার অনুকূল উপাদান পাননি। তাঁরা ঔপনিবেশিক সরকারের শাসনাধীন, নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে একেবারেই সচেতন নন, অধিকার আদায়ে সচেতনতার অভাবে পারঙ্গমও নন। আর ইংল্যান্ডের নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রাপ্তিতে ভারতীয়দের তুলনাই চলে না, কারণ নাগরিকের স্বাধীনতাই ভারতীয়দের নেই। যদি জোটে তখন নাগরিকরা ‘পাব্লিক’রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন কি না তা ভাবা যাবে।
ব্যক্তি সজাগ-সচেতন হলেই তবে সামূহিক ভাবে প্রজা হওয়া যাবে। ফাইল চিত্র।
রবীন্দ্রনাথ এর সঙ্গে আর একটি বিষয়ও যোগ করে দিচ্ছেন। পরাধীন ভারতের লক্ষ্য কী? ইংল্যান্ডের মতো নেশন রূপে আত্মপ্রকাশই কি তার সাধনা হবে? যদি সাধনা হয় তা হলেই কিন্তু পাব্লিক নামের অধিকার সচেতন ভোটাধিকারপ্রাপ্ত জনসমূহের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি নেশনের মডেল ভারত গ্রহণ না করে তা হলে জনসমূহের চরিত্র আর এক রকম হবে, হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পাব্লিক সর্বসাধারণ, মানবসাধারণ নয়। মানবসাধারণ নির্বিশেষ, সর্বসাধারণ বিশেষ। যেখানে নেশন নেই, ভোটাধিকার নেই সেখানে মানবসাধারণ আছেন, পাব্লিক বা সর্বসাধারণ নেই। সেই মানবসাধারণ নেশনের বিকল্প কোনও ব্যবস্থাও গড়ে তুলতেই পারেন, পাব্লিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ না করেও নিজেদের ন্যায়-বিচার পেতে পারেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মতে পাব্লিক বিশেষ দেশ-কালের সর্বসাধারণ। ভারতীয়রা ইংল্যান্ডের নাগরিকদের মতো, পাশ্চাত্যের আরও অনেক দেশের অধিবাসীদের মতো পাব্লিক বা সর্বসাধারণ রূপে নিজেদের গড়ে তুলবেন কি না তাই বিচার্য।
আরও পড়ুন: ভোটের মুখে প্রণব ভারতরত্ন
পাশ্চাত্যে নেশনের হাতেই পাব্লিকের উত্থান। নেশনতন্ত্রে পাব্লিক নিজের অধিকার আদায় করে। শুধু আদায় করে না, নিজের ভূখণ্ডে নেশনের সমৃদ্ধির জন্য অনেক সময় নায়কের কথা মতো অন্য নেশনের মুণ্ড চায়, যুদ্ধ লাগায়। অন্য দেশের পাব্লিক তার শত্রু। এ জন্যই পাব্লিককে মানবসাধারণ বলতে রবীন্দ্রনাথের আপত্তি। যে নেশন পাব্লিক তৈরি করে সেই নেশন পাব্লিককে অন্য নেশনের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ যে আত্মশক্তি সম্পন্ন প্রজার কথা লেখেন সে রাষ্ট্রনৈতিক নয়, সামাজিক। ফলে রাজা বা নেশন তাকে জাগিয়ে তোলেনি, রাজা বা নেশন তাকে কাজেও লাগাতে পারে না। অন্য রাষ্ট্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নেশা সচেতন সামাজিকের কেন থাকবে? রবীন্দ্রনাথের প্রজা পাব্লিক নয় বলেই মানবসাধারণের প্রতিরূপ।
রবীন্দ্রনাথ যা চেয়েছিলেন তা হয়নি। আমাদের দেশ স্বাধীন দ্বিখণ্ডিত নেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল, স্বাধীন হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের তখন প্রয়াণ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সামাজিক আদর্শের কথা যিনি বিবেচনা করতেন সেই গাঁধীকে স্বাধীন ভারত হত্যা করেছিল। এই দেশে তবু প্রজাতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়। আমাদের এই দেশের প্রজা বহুমাত্রিক— বর্ণ ও ধর্মের নানাত্ব রয়েছে। তাঁরা নিজেদের অস্তিত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে ব্যক্তিগত ভাবে সচেতন হয়ে সামূহিক ভাবে যদি মিলিত হতে পারেন তা হলেই প্রজাতন্ত্র সার্থক। অথচ মুশকিল হল আমাদের নেতারা নিজেদের স্বার্থেই মাঝে মাঝে নেশন নেশন করে হাঁক-ডাক করেন। নেশনের নামে একদল পাব্লিককে বড় করে তোলেন। এ দেশে সেই নির্দিষ্ট ধর্মের ও বর্ণের বাইরে যে মানুষ আছেন, তাঁরা যে মানবসাধারণের অংশ, তাঁদের যে প্রজা হিসেবে এই দেশে তন্ত্র অর্থাৎ অধিকার আছে সে কথা ভুল হয়ে যায়। তখনই প্রজাতন্ত্রের অবমাননা।
নেশন হিসেবে যে ভারত আত্মপ্রকাশ করেছে তাকে প্রজাতন্ত্রে সম্প্রসারিত করাই আমাদের সকলের কাজ। নিজেদের অনুশীলন করতে হবে সে ব্রত। প্রজা হিসেবে নিজেদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে বজায় রেখে মিলতে হবে। যেখানটা মেলে না সেখানটাকে নেশনের নামে কেটে বাদ দেওয়া চলবে না, অ্যান্টিন্যাশনালের নামে চাপা দিলে চলবে না। সে কাজ নেশন করে, প্রজাতন্ত্র করে না।
প্রজাতন্ত্র হয়ে ওঠাই আমাদের সাধনা।
(লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক)