আর্মস্ট্রং ও অলড্রিনের চন্দ্রজয় ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। চন্দ্রাভিযানের আগে কয়েক মাস পশ্চিম আমেরিকার মরুভূমি অঞ্চলে যখন ট্রেনিং চলছিল, সেই সময় এক দিন তাঁদের সঙ্গে দেখা ওখানকার এক বৃদ্ধ আদিবাসীর। বৃদ্ধের বিস্ময়, ‘‘এত জায়গা থাকতে চাঁদে যেতে হচ্ছে কেন বলো তো?’’ নভশ্চররা জবাব দিলেন, ‘‘এ হল একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা।’’
কিন্তু সেখানে যে আদিবাসীর ঈশ্বরের বাস! ‘‘যাচ্ছ, ভাল কথা; তবে তাঁকে যদি আমাদের হয়ে একটা বার্তা দিতে পারো বড় ভাল হয়।’’ বৃদ্ধের বার্তা এক বর্ণও বুঝলেন না নভশ্চররা। ‘‘কথাগুলোর মানে কী? এটা কোন ভাষা?’’ বৃদ্ধের মুচকি হাসি, ‘‘সে তোমরা বুঝবে না, এ আমাদের ভাষা। শুধু আমরা বুঝি আর বোঝে চাঁদের দেবতা। তোমরা শুধু কথাগুলো মুখস্থ করে ফেলো, তার পর দেবতার সঙ্গে দেখা হলে বলে দিয়ো।’’
নভশ্চররা এক জনকে পেলেন যিনি ওই ভাষা বোঝেন। বৃদ্ধের শেখানো কথাগুলো তাঁকে শোনালেন। খুব এক চোট হেসে নিয়ে তিনি বললেন, ‘‘এর মানে হল: শোনো হে দেবতা, এই লোক দুটো যে পরীক্ষাটরিক্ষার কথা বলছে ও সব ডাহা মিথ্যে; একটা কথাও বিশ্বাস কোরো না; এরা এসেছে এখানকার জমিজিরেত লুট করতে!’’
নিছক গল্প। জেরুসালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের অধ্যাপক জ়ুবাল নোয়া হারারি গল্পটির উল্লেখ করেছেন সেপিয়েন্স: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব হিউম্যানকাইন্ড (২০১৪) বইটিতে। অন্তত তিরিশটি ভাষায় অনূদিত এ বইয়ে লেখক শুধু মানব প্রজাতির বিবর্তনের ইতিহাস বলেন না; আয়নার সামনে নিজেদের দাঁড় করিয়ে বুঝিয়ে দেন, বিবর্তনের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী বুঝি আমরাই। আমরা অনন্য, কারণ উন্নয়নের নামে, অগ্রগতির নামে, এমনকি শুধু টিকে থাকার স্বার্থেও আমরা ভয়াবহ যুক্তি রচনা করতে পারি।
যেমন গণহত্যা। নতুন কিছু না। বরং কী কারণে, কোন যুক্তিতে আর কত বিচিত্র উপায়ে তা করা যায় সেই উন্মেষশালিনী প্রতিভাগুলোই নতুন। আমাদের প্রাগিতিহাস তা-ই বলে। উদ্ভব আর বিবর্তনের সমস্ত কাল জুড়ে আমরা পরিবেশের সমস্ত প্রজাতি, এমনকি মনুষ্য সদৃশ অন্য প্রজাতিগুলোকেও ধ্বংস করেছি। ধ্বংসকাণ্ড আজও চলছে, আমাদের বর্বরতা বাঁধনহারা। এবং নিজেদের প্রজাতির নাম দিয়েছি— বিজ্ঞ মানুষ, হোমো সেপিয়েন্স!
কেমন হত যদি অন্য মানব প্রজাতিগুলো একই সঙ্গে বেঁচেবর্তে থাকত? বিজ্ঞ প্রজাতি হিসেবে আমরা কি তাদের সহ্য করতাম? ডারউইন তো বলেছিলেন, আমাদের এই প্রজাতি হল প্রাণিজগতের শুধু আর এক রকম প্রাণী, তার চেয়ে বেশি কিছু না। সে কথা আমাদের ভাল লাগেনি, বলেছি, আমরাই মহত্তম, তাই টিকে থাকার অধিকার কেবল আমাদেরই। নিয়েনডারথালরা বেঁচে থাকলে তারা কি আমাদের এই দাবি মানত? বারো হাজার বছর আগে বামন-সদৃশ যে মানুষগুলোকে নির্বংশ করে আমরা কীর্তিমান হয়েছি তারা কি আমাদের দাবি মানত? হারারি বলছেন, মনে হয় না।
নাৎসিদের কাছে মানবিকতার অর্থ ছিল ভিন্ন। তারা ভাবত, আমাদের এই মনুষ্য প্রজাতিই বিবর্তনের শৃঙ্গ। সত্যিকারের মানবিক হতে গেলে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’-এর নিয়ম মানতেই হবে। যারা সবচেয়ে উপযুক্ত তারাই বেঁচে থাকবে, উৎপাদনের অধিকার কেবল তাদেরই। যারা উদার বা কমিউনিস্ট তারা দুর্বলের বাঁচার অধিকার নিয়ে কথা বলে, তারা আসলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের বিরুদ্ধেই কথা বলে। তা হলে তো উপযুক্তরা দুর্বলদের ভিড়ে হারিয়ে যাবে, পৃথিবী বলহীন হয়ে পড়বে। অতএব, প্রাকৃতিক নির্বাচনের হাল ধরতে হবে নাৎসিদেরই। এই ভাবে আমরাও হাল ধরি। যারা ক্ষমতার স্বাদ পায় তারা বিরোধিতা পছন্দ করে না, বরদাস্তও করে না, সে ভোটযুদ্ধ হোক বা তামার খনি।
বিংশ শতকের শেষে এসে দেখা গেল, আধুনিক মানুষ প্রাকৃতিক নির্বাচনের বেড়াটাকেই ভাঙতে চায়। সেই লক্ষ্যেই তাঁর গবেষণা। আমরা এত উন্নত হয়ে গিয়েছি যে প্রকৃতির দাসত্ব আর পোষায় না! সারা দুনিয়া জুড়ে গবেষণা, কী ভাবে উন্নততর মানুষ তৈরি করা যায়। সুউন্নত, কিন্তু সে যেন বিজ্ঞ মানুষের অঙ্গুলিহেলনে চলে। মুশকিল এই যে, যার বিরুদ্ধে এত বিপ্লব সেই প্রকৃতি নিজে দাসপ্রথায় বিশ্বাস করে না। তার মন্ত্র, সহনশীলতা। কিন্তু আমরা ধরে নিয়েছি, ওই মন্ত্র মেনে নিলে আর মহত্তম হওয়া যায় না। আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমাদের উদ্ভবের পর সত্তর হাজার বছর কেটে গিয়েছে। উদ্ভবের কালে না-হয় আমাদের আলাদা কোনও তাৎপর্য ছিল না; কিন্তু এখন তো আমরাই ঈশ্বর।
সত্যিই কি তেমন ঐশী শক্তি আমাদের আছে? আমরা পরিবেশের উপর খবরদারি করতে পারি, খাদ্যের জোগান বাড়াতে পারি, নগর পত্তন করতে পারি, এমনকি প্লাস্টিক মানুষও তৈরি করতে পারি। কিন্তু সহনাগরিকের চোখের জল কি মুছে দিতে পারি? বৈভব দিতে পারি; কিন্তু স্বস্তি? আমরা শুধু নিজের প্রজাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ধনলুণ্ঠন করতে পারি। নিজের প্রজাতির স্বার্থে অন্য প্রজাতিগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি। তার পর নিত্যনতুন ভাইরাসের প্রকোপ দেখে কান্না জুড়ে দিতে পারি। তাই আমাদের অলঙ্কৃত উত্তরণের ইতিহাসে গৌরব খুঁজে পাওয়া কঠিন। মনে হয়, এই প্রজাতির কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, নেই সন্তুষ্টিও।
যখন নিয়েনডারথালদের সমূলে ধ্বংস করছিলাম তখন আমরা শক্তিশালীই ছিলাম। আজ আমরা তার চেয়ে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু সেই অমিত শক্তি দিয়ে ঠিক কী করব তা জানি না। এমন লক্ষ্যহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন ঈশ্বর কি মহাকালের ইতিহাসে আর কখনও এসেছে? দু’শো বছর আগে, ১৮১৮ সালে মেরি শেলির কল্পিত ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সৃষ্টির কাহিনি, এখন মনে হয়, ছিল অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী। প্রযুক্তি আমাদেরই সৃষ্টি; কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এই প্রযুক্তি থেকে এ বার যে জীবটি সৃষ্টি হবে সে হবে ‘বিজ্ঞ’ মানুষের চেয়েও শক্তিধর, চেতনাশূন্য, চমকপ্রদ এবং বীভৎস। ‘বীভৎস মজা’-র দিন সমাগতপ্রায়। যে রাজনীতিকদের আমরা প্রতি দিন দেখছি, যে ধ্বংসপ্রিয় বিজ্ঞানীদের উল্লাস আমরা শুনছি, তাঁরা কি বিজ্ঞ মানুষ, হোমো সেপিয়েন্স?