ভারতে প্রাচীন প্রথা তথা বিবাহিতা মহিলার নিজস্ব স্ত্রীধনের উপরেও স্বামীর একচেটিয়া অধিকার জন্মে গিয়েছে।
বিভিন্ন তহসিলদার বড় বড় অঞ্চলের ক্ষমতা পেয়ে জমিদার হয়ে গেল। এবং তাদের উপর দায়িত্ব বর্তাল বছরের নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে ব্রিটিশ নির্ধারিত কর প্রজার কাছ থেকে তুলে জমা দিতে হবে। ফসল উদ্বৃত্ত হোক বা না হোক। এই আইনের বলে ভারতীয়েরা প্রথম জমির ব্যক্তিমালিকানার অধিকার পেল। কিন্তু একই সময়ে নারীদের সম্পত্তির অধিকার আর রইল না।
ওই সময়ে ব্রিটেনে নারীর সম্পত্তির অধিকার নিয়ে ঠিকঠাক ধারণাই তৈরি হয়নি। যেখানে ভারতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই স্ত্রীধন তথা বিবাহিতা মহিলার সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেখানে ব্রিটেনে ১৮৭০ সালে প্রথম ম্যারেড উমেন্স প্রপার্টি অ্যাক্ট-এর মধ্যে দিয়ে বিবাহিতা ইংরেজ মহিলার সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়।
এ দিকে ভারতে তত দিনে প্রাচীন প্রথা তথা বিবাহিতা মহিলার নিজস্ব স্ত্রীধনের উপরেও স্বামীর একচেটিয়া অধিকার জন্মে গিয়েছে। এবং পুরুষ বুঝতে পেরে গিয়েছে, স্ত্রী বাপের বাড়ি থেকে যা সম্পত্তি নিয়ে আসবে, তার মালিক হবে পুরুষ। ফলে, বিবাহযোগ্য পুরুষ তেমন পরিবারের মেয়েই খুঁজতে লাগল, যে পরিবার যথেষ্ট কন্যাদান দিতে পারবে। এই ভাবে পরিবারে পুত্রসন্তান একটি অতিরিক্ত রোজগারের উৎস হয়ে দাঁড়াল। আর কন্যাসন্তান অর্থনৈতিক দায় হয়ে দাঁড়াল। যা পরবর্তী সময়ে কন্যাভ্রূণ হত্যা, তথা নারী-পুরুষ অনুপাতে ভারসাম্যহীনতার কারণ হয়ে উঠল। যা এখনও ভারতের সবচেয়ে বড় সামাজিক সমস্যাগুলির মধ্যে একটি।
যে ভারত মেয়েদের দেবীজ্ঞানে পুজো করত, যে ভারতে এক সময়ে স্বয়ংবর সভায় পুরুষ নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে তবেই পাণিগ্রহণ করতে পারত। সেই ভারতে, সম্পূর্ণ ব্রিটিশ প্রভাবে, পুরুষের অতিরিক্ত পণের চাহিদাই বধূনির্যাতন এবং বধূহত্যার মতো অপরাধের সংখ্যা অনেকটা বাড়িয়ে দিল। বাড়িয়ে দিল বিধবা মহিলাদের একঘরে করে রাখার প্রবণতা। কারণ, তার কোনও অর্থনৈতিক গুরুত্ব নেই।
এই ঘটনা পরম্পরা কমাতে গেলে নারীর সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সেটা বুঝতে পেরেই ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৭ সালে দ্য হিন্দু ওমেন’স রাইট টু প্রপার্টি অ্যাক্ট লাগু করে। তবে তত দিনে পণপ্রথা একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। বিয়ের মূল কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে টাকা-পয়সার লেনদেন।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও পণপ্রথার সমস্যা বাড়তেই থেকেছে। হতবাক হওয়ার মতো বিষয় যে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রত্যেক দিন ভারতে ২১জন মহিলা মারা যাচ্ছেন পণের দাবির নির্যাতনে। অথচ, সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই ভারতের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সংগঠিত হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন একের পর এক। এবং আইনপ্রণেতারা তৎপর হয়েছেন নতুন নতুন আইন প্রণয়নে। পণপ্রথা আটকানোর জন্য ভারতের ফৌজদারি আইনই জোরদার করা হয়েছে। ১৯৬১ সালে পণপ্রথা রদ আইন, ১৯৮৩ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ৪৯৮-এ এবং ১৯৮৬ সালে ৩০৪-বি ধারার অন্তর্ভুক্তি পণের জন্য নির্যাতন, এবং নির্যাতনের ফলে মৃত্যুর ঘটনাকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে। যেহেতু, পণপ্রথার সমস্যাটি মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার না থাকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত, তাই ১৯৫৬ সালে হিন্দু সাকশেসান অ্যাক্ট লাগু করে সম্পত্তির অধিকার আইনে বিভিন্ন সদর্থক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। যার মধ্যে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, প্রাচীন স্ত্রীধন প্রথাকে অনুসরণ করে নারীদের সম্পত্তির সমান অধিকারকে সুনিশ্চিত করা। ২০০৫ সালে হিন্দু সাকশেসান অ্যাক্টের সংশোধন নারী এবং পুরুষের মধ্যে সম্পত্তির অধিকারের যেটুকু পার্থক্য বিদ্যমান ছিল, সেটাকেও বিলুপ্ত করেছে।
কিন্তু শুধু আইনের দাওয়াই দিয়ে সামাজিক ব্যাধির চিকিৎসা করা যায় না। সমাজ একটা দেহ হলে এক-এক জন ব্যক্তি সেই দেহের এক-একটি কোষ। ফলে, ব্যক্তিমানসের ব্যাধি আগে দূর করা দরকার। যে সমস্ত মানুষ এখনও বিয়ের সময়ে মেয়ের বাড়ি থেকে আসা পণের উপরেই একটি মেয়ের গুরুত্ব নির্ধারণ করেন, তাঁরা এই সভ্য সমাজে বসবাসের যোগ্য নন। আর তাদের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর সেই সমস্ত শিক্ষিত মানুষ, যাঁরা পণের দাবি মেনে নেন।
এই পণের দাবি মেনে নেওয়ার পিছনে কাজ করে শতাব্দীপ্রাচীন নারীবিদ্বেষ এবং নিজের কন্যাসন্তানকে দায় ভাবা। পণের দাবি মেনে নিয়েই কন্যাসন্তানকে বিবাহ-পরবর্তী নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তাঁরা। কারণ, এটুকু বুঝে নেওয়া দুষ্কর নয় যে, কেউ যদি টাকার জন্য বিয়ে করতে পারে, সে আরও টাকার জন্য নিজের স্ত্রীকে নির্যাতন করতেই পারে।
কাজেই যেটা দরকার, কন্যাসন্তান কখন বিবাহযোগ্য হচ্ছে সে দিকে তাকিয়ে থাকার বদলে কন্যাসন্তানকে যোগ্য করে তোলা। কন্যাসন্তানকে দায় না ভেবে এক জন সন্তান হিসেবেই ভাবতে শুরু করা। এক জন স্বাবলম্বী, স্বাধীনচেতা নারী কখনও পণের দাবি বা সে জন্য নির্যাতন মেনে নেওয়ার মতো দুর্বল নয়। পণপ্রথার সম্পূর্ণ বিলোপসাধন যদি সম্ভব হয়, তা হবে সবলা নারীদের চিৎকৃত প্রতিবাদেই ।
লেখক কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী