উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়ার কপালও কি ওদের নেই?

কেউ কি ওই মাস্টারমশাই হতে পারছেন না যিনি সব দেখতে পান? পড়ুয়াকে কাছে টেনে বিপথু হওয়ার হাত থেকে আড়াল করেন, খুব কি কঠিন তা? উত্তর খুঁজছেন জিনাত রেহেনা ইসলামকেউ কি ওই মাস্টারমশাই হতে পারছেন না যিনি সব দেখতে পান? পড়ুয়াকে কাছে টেনে বিপথু হওয়ার হাত থেকে আড়াল করেন, খুব কি কঠিন তা?

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০২:৪২
Share:

কিছু শিক্ষকের গাফিলতির কারণেই কি আজ নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে? ‘অমুক শিক্ষক করছে না, আমি কেন করব?’ ‘অমুক বিদ্যালয় তো এমন কড়াকড়ি করছে না।’— এ সব উদাহরণের আশ্রয় নেওয়া কি উচ্চশিক্ষিত পেশাদার ব্যক্তির আদর্শ হতে পারে? ব্যক্তিগত বিবাদে লিপ্ত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার বদলে কোথাও কি প্রতিরোধের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে?

Advertisement

অভিভাবক যখন বলছেন, ‘কই, কোন শিক্ষক কড়াকড়ি করছে, দেখা তো!’ তখন সেই শিক্ষক ভরা বিদ্যালয়েও কি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন? নাকি সহকর্মীরা তাঁকে সতর্ক করছেন, ‘কী দরকার এত কিছু করার?’ এই বাড়তি ভয় দেখানোর কাজটা কি কখনও ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু সব দেখেছেন’— এই সাহসে ভর করে সাবালক হতে শিখবে না?

একটি ঘরে প্রতি কুড়ি জন পড়ুয়া পিছু দু’জন শিক্ষকও কি ওই মাস্টারমশাই হতে পারছেন না যিনি সব দেখতে পান? চোদ্দো, পনেরো বছরের ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে তাদের বিপথে চালিত হওয়া থেকে রক্ষা করা কি এতটাই কঠিন?

Advertisement

অভিভাবকদের অভিযোগ, ‘‘সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে ক্লাস হয় না। শিক্ষক সময় মতো ক্লাসে যান না। সিলেবাস শেষ করেন না। তাই আর ছেলেকে স্কুল পাঠাই না। শুধু পরীক্ষার সময় যায়।’’ তা হলে ফর্মেটিভ টেস্টে নম্বর পাচ্ছে কী করে? পিকক কার্ড পূরণ হচ্ছে কী করে? স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছু বলছেন না?

এক অভিভাবকের কথায়, ‘‘আগে ছেলেমেয়ে স্কুলে না গেলে চিঠি লাগত। এখন আর সে সব লাগে না। আমাদের ছেলেরাও বাইরে টুকিটাকি কাজ করছে।’’

আর যারা স্কুল পালিয়ে অন্য কিছু করছে? সে দায় কার? এই অকালে ঝরে যাওয়া, নেশার কবলে পড়া বাচ্চাগুলোর কী হবে? তাদের উপযুক্ত অভিভাবক নেই। কিন্তু এক জন উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়ার কপালও কি তাদের নেই?

শিক্ষকেরা গর্জে ওঠেন, ‘‘প্রধান শিক্ষকেরা কোথায় নিয়ম মানেন? তাঁরাই তো স্বজনপোষণকে প্রশ্রয় দিয়ে আসছেন। ডিভাইড অ্যান্ড রুলের প্রয়োগ করে বিদ্যালয়ে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা তাঁরাই জারি করে রেখেছেন।’’ পরীক্ষা চলাকালীন স্পষ্ট নির্দেশ, হলে কোনও মিডিয়া বা সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক যেতে পারবেন না।

অথচ বোর্ডের নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে অবাধ বেনিয়ম। নিয়ম ভঙ্গকারীরাই দলে এত ভারী হয়ে গিয়েছে যে অরাজকতাই এখন নিয়ম। শাস্তি কে কাকে দেবে? নিয়ম দিয়ে কী হয়? নিজেদের মধ্যে ‘অ্যাডজাস্ট’ করে চললেই কোনও আইন কিচ্ছুটি করতে পারবে না। ‘ফেস ইজ দ্য ইন্ডেক্স অব মাইন্ড’। প্রধানশিক্ষক যদি ব্যক্তিত্ববান না হন, তবে বিদ্যালয়ে নিয়ম-কানুন কে প্রয়োগ করবেন? বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত থেকে শুরু করে নকল করে পাশ করা— এই অনাচার কেন? অভিভাবকদের সঙ্গে বসে পড়ুয়াদের বিদ্যালয়ে না আসা ও নকল বন্ধ করার জন্য বোঝানোর কথা তাঁরই। তাঁর সহযোগিতার জন্য রয়েছে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল ও স্টাফ কাউন্সিলের সেক্রেটারি। তাঁরাই তো বিদ্যালয়ের স্বার্থে যাবতীয় ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করবেন।

দোষারোপের শীর্ষে যিনি দাঁড়িয়ে, তিনিও সব জানেন। এই অনিয়ন্ত্রিত পড়ুয়ার দল যদি এ ভাবে নিয়ম ভাঙতে ভাঙতে যায়, তবে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র, গোলা বারুদ দরকার নেই! দেশ ধংসের জন্য এক বোধহীন, গাজোয়ারি করার আস্ফালনে মত্ত কিশোরদলই যথেষ্ট। তারা জানে, নিয়মভঙ্গ করার অধিকার পেতে হয়। কিন্তু কেন? এই অধিকার দিয়ে কী হয়? অনেকেই জানে না।

কিন্তু তারা বোঝে, তাদের একটা ‘লাইফ’ আছে। এই ‘লাইফ’ কার জন্য, তারা ভাবে না। তারা পড়ে বাবা-মায়ের জন্য। নকল করে পাশের জন্য। চাকরি পায় নিজেদের জন্য। কর্মক্ষেত্রের নিয়ম পরোয়া করে না। কারণ, তারা জানে বেপরোয়ারা দলে ভারী। মানে, তারা নিরাপদ। তারা যতক্ষণ নিরাপদ, ততক্ষণ তারা প্রত্যেকে নিজেই মর্জির রাজা। তাকে যারা রাজা বানিয়েছে তাঁদের ক্ষমা করার দায় ইতিহাসের।

‘ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব কমন ম্যান’— এ ডায়ালগ চিরসত্য ও গণতান্ত্রিক। আজকের শিরদাঁড়াহীন এই ‘কমন ম্যান’ তৈরির দায় শিক্ষককূল কেন একা নিতে যাবে?

এই অনাসৃষ্টির কাণ্ডকারখানায় কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও জনপ্রতিনিধি, কোনও প্রশাসক কি তাদের দায় অস্বীকার করতে পারে? ‘ইন্টেলিজেন্স প্লাস ক্যারেক্টার দ্যাটস দ্য গোল অব ট্রু এডুকেসন’— এই সত্যকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে কেউ কসুর করেনি। তাই সময় এসেছে শাস্তির জন্য সকলের প্রস্তুত থাকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দেবে হিসেব। সে দিন অস্তগামী সূর্যের কাছে থাকবে উত্তরপুরুষের করুণ আকুতি— বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে!

শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাই স্কুল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন