অতঃপর অ্যামিবা

আজ ভারতে, তথা পশ্চিমবঙ্গে, নাগরিকের মত প্রকাশের সুযোগ নাই, তাহা স্মরণ করাইয়া পৃষ্ঠ-বার্তা প্রশ্ন তুলিল, তবে কি নিজের পৃষ্ঠদেশ ভিন্ন অপর স্থান অবশিষ্ট নাই নাগরিকের?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:১৪
Share:

চাঁদনি চক এলাকায় সেই ব্যক্তি।

প্রাচীন গ্রিসে এক বৃদ্ধ দিনের বেলা হাতে জ্বলন্ত লন্ঠন লইয়া ঘুরিয়া ফিরিতেন। কেহ প্রশ্ন করিলে বলিতেন, তিনি মানুষ খুঁজিতেছেন। লন্ঠন জ্বালিয়া সেই বৃদ্ধ— ডায়োজিনিস তাঁহার নাম— মনে করাইতেন, আলো দুর্লভ নহে, মনুষ্যগুণ-বিশিষ্ট মানুষই দুর্লভ। সেই কৌশল স্মরণ করাইলেন কলিকাতার এক নামহীন নাগরিক। তিনি নিজের পিঠে নানা বার্তা বহন করিয়া ফিরিতেছেন। কাগজে লিখিত কথাগুলি আপাতবিচারে অর্থহীন, হাস্যকর। কিন্তু বস্তুত এগুলি সুচিন্তিত প্রতিবাদের বার্তা। যেমন, ‘আপনি ঠিক, আমি ভুল।’ আপাতদৃষ্টিতে ইহা একটি মীমাংসা, কিন্তু কথাটি ইঙ্গিত করিতেছে, আজ বিতর্কের সুযোগ নাই। সরকার এবং নাগরিকের কোনও প্রকার সংলাপের সুযোগ নাই। মন্ত্রী ও আধিকারিক নিজেরাই সিদ্ধান্ত লইতেছেন, এবং ‘কুমিরের শ্যাম্পুর কারখানা’ নির্মাণ করিতেছেন, অর্থাৎ অর্থহীন প্রকল্প গড়িয়া অপচয় বাড়াইতেছেন। এই তাচ্ছিল্যের প্রতিবাদে নেতার প্রতি বাক্যাঘাত, ‘আপনি ঠিক।’ এই সামান্য সমালোচনাও যে নেতাদের অসহনীয় মনে হইবে, তাহা ওই নাগরিক বিলক্ষণ বুঝিয়াছেন। তাই সাংবাদিককে নিষেধ করিয়াছেন নাম প্রকাশ করিতে। তাঁহার পৃষ্ঠের প্রতিবাদ-বার্তা, ‘মানুষ দুই প্রকার, গোরিলা ও অ্যামিবা।’ গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক কত ক্ষুদ্র, অকিঞ্চিৎকর হইয়া পড়িয়াছে, বুঝাইতে এককোষী প্রাণীর উপমা টানিতে হইল।

Advertisement

আজ ভারতে, তথা পশ্চিমবঙ্গে, নাগরিকের মত প্রকাশের সুযোগ নাই, তাহা স্মরণ করাইয়া পৃষ্ঠ-বার্তা প্রশ্ন তুলিল, তবে কি নিজের পৃষ্ঠদেশ ভিন্ন অপর স্থান অবশিষ্ট নাই নাগরিকের? গণতন্ত্রে নাগরিক সমাজ কি ছোট হইতে হইতে প্রতিবাদীর দেহাংশ অবলম্বন করিয়া বাঁচিয়া আছে? এক দিন কথাটি হাসিয়া উড়াইবার উপায় ছিল, আজ আর নাই। ভারতে আজ বিরোধিতার অর্থ হইয়াছে শত্রুতা। বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করিলেই নাগরিক সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী বলিয়া গণ্য হইবে, রাষ্ট্রদ্রোহী বা সন্ত্রাসবাদী বলিয়াও চিহ্নিত হইতে পারে। জঁ দ্রেজের মতো গবেষকও অপদস্থ হইয়াছেন, কারারুদ্ধ হইয়াছেন দলিত-আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত সাহিত্যিক, সমাজকর্মী, আইনজীবীরা। ইহার পর জনমত সংগঠিত করিবার ঝুঁকি কে লইবে? নাগরিক পরিসরে ব্যক্তিগত মত প্রকাশও বিপজ্জনক। ‘ফেসবুক’-এ সরকারের সমালোচনা করিয়া যাঁহারা কারারুদ্ধ হইয়াছেন, কাজ হারাইয়াছেন, নিগৃহীত হইয়াছেন, সে সংখ্যাও কম নহে। সরকারি তথ্যের সত্যতা লইয়া প্রশ্ন করিলেও মন্ত্রীরা ক্ষিপ্ত হইয়া ওঠেন, যেন নির্বাচিত হইলে প্রমাণ দিবার দায় থাকে না। নিরুপায় নাগরিক বিদ্রূপ-নিষিক্ত বার্তা বহিয়া ফেরে, ‘আপনি ঠিক, আমি ভুল।’

ইহার অর্থ, আজ নাগরিক যথার্থ নেতা খুঁজিতেছেন, যিনি নাগরিকের কথা শুনিবেন, এবং শিখিবেন। যিনি বাকস্বাধীনতা সুরক্ষিত করিবেন, যাহাতে নাগরিক সংবাদপত্র, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটকে নিজের কথা নির্ভয়ে বলিতে পারে। চলচ্চিত্রের মুক্তি রুদ্ধ করিয়া, সরকার-পোষিত প্রেক্ষাগৃহ হইতে নাটককে নির্বাসন দিয়া নাগরিকের মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করিতে চাহেন যে নেতারা, তাঁদের সেই ত্রাসের রাজত্ব হইতে মুক্তি খুঁজিতেছে সমাজ। গোরিলার শক্তি অ্যামিবার নাই। কিন্তু গোরিলাকে পুনরায় অ্যামিবায় পরিণত করিবার শক্তি তাহার আছে।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন