স্কুলবাড়ি রং করতে এত টাকা বরাদ্দ, শিশুর খাবারেই অর্থাভাব

ডিম গিয়েছে চুরি

১৯ বছর পর যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, প্রস্তাব এল, শিশুবিভাগেও দুধ তুলে দেওয়া হোক। চল্লিশ লক্ষ পাউন্ড বাঁচবে। রাজি হননি থ্যাচার। নোটে লিখেছিলেন, ‘‘নিন্দার যে ঝড় সইতে হয়েছে, তার পর আবার?’’ 

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

কড়া হেড মাস্টারমশাইদেরও মাঝে মাঝে জল আসে চোখে। মিড ডে মিল চলছে। দিনটা বুধবার। জেলায় ওই দিন সব ইস্কুলে ডিম দেওয়ার কথা মিড ডে মিলে। সবাই ডিম পেল কি না, তদারকি করতে গিয়ে হেডমাস্টার দেখেন, শুধু সব্জি দিয়ে ভাত খাচ্ছে এক ছাত্রী। ‘ডিম পাসনি?’ ভিতু চোখে মেয়েটি তাকায়। পেয়েছে, কিন্তু না খেয়ে রেখে দিয়েছে সে। বাড়ি নিয়ে যাবে। ছোট ভাইটা খাবে।
একটা ডিমের কত দাম, বুঝতে হলে গরিব এলাকার সরকারি ইস্কুলে দুপুরবেলা গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তখন বোঝা যায়, ‘ছ’টাকায় একটা’ বললে ডিমের দাম বলা হয় না। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুরা যে আগ্রহে অপেক্ষা করে ডিমের জন্য, পাতে ডিম পড়লে যে কলরব ওঠে, তা-ই হল ডিমের দাম। অপেক্ষা তো কম নয়। অধিকাংশ জেলার মিড ডে মিলের রুটিনেই লেখা ছ’দিনের অপেক্ষা। আসল ছবি কেমন? কলকাতার স্কুলে সপ্তাহে দুটো গোটা ডিম। মুর্শিদাবাদে বেলডাঙার মাদ্রাসায় সপ্তাহে এক দিন, আধখানা ডিম। সুন্দরবনের বালিদ্বীপের প্রাথমিকেও তাই। মালদহের হবিবপুরের একটি স্কুলে মাসে দুটো ডিম। বীরভূমের রূপপুর-সুপুরে একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রে মাসে এক দিন, একটা।
কেন এই দশা? শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’ গল্পে অনাথ বালকের খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ে। ‘‘কেষ্ট খাইতে বসিয়াছিল। একটা পিতলের থালার উপর ঠাণ্ডা শুকনা ড্যালাপাকান ভাত। একপাশে একটুখানি ডাল ও কি একটু তরকারির মত। দুধটুকু পাইয়া তাহার মলিন মুখখানি হাসিতে ভরিয়া গেল।’’ কাদম্বিনী যে সৎভাই কেষ্টকে মাছ-দুধ দিতে পারেনি সে অভাবে নয়, স্বভাবে। আজও কি গরিবের শিশুকে তেমনই উটকো আপদ বলে দেখেন কর্তারা? বীরভূমের চন্দনপুর শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের আদিবাসী শিশুরা মাসে এক দিন ডিম পায়। কেন? সহায়িকা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। ‘‘মাথাপিছু দিনে চার টাকা তেরো পয়সা, আর একটা ডিমই পাঁচ-ছ’টাকা। আপনি খাইয়ে দেখান না!’’ কর্তাদের জানিয়েছেন? ‘‘বিডিও অফিস বলল, কুলোলে দেবেন, না হলে দেবেন না।’’
যেন কাঙালি ভোজন। যেন ‘খাদ্যের অধিকার’ নামে কোনও আইন নেই। যেন দিনে বারো গ্রাম প্রোটিন দেওয়ার নির্দেশ দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। পারলে দিন, না পারলে হাত উল্টে দিন। কেন্দ্র টাকা বাড়াচ্ছে না, কী করব? হ্যাঁ, এ রাজ্যের তিনটি শিশুর এক জনের ওজন কম। তাতে কী এসে গেল?
কেন? তামিলনাড়ু যা পারে, এ রাজ্য তা পারে না কেন? সেখানে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির পড়ুয়ারা সপ্তাহে পাঁচ দিন ডিম পায় মিড ডে মিলে। দিনে পঁয়তাল্লিশ লক্ষ ডিম কেনে তামিলনাড়ু, সরাসরি চাষিদের থেকে। আর পশ্চিমবঙ্গ? এ রাজ্য তামিলনাড়ু থেকে ‘সবার জন্য রেশন’ নীতিটা নিল, কিন্তু ‘সব শিশুর জন্য ডিম’ নীতিটা এড়িয়ে গেল। এ রাজ্যের পড়ুয়াদের জন্য বছরে ২২০ দিন ডিমের খরচ পড়ত বছরে কম-বেশি ৬৯৩ কোটি টাকা। বেশি বুঝি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাড়ার ক্লাবদের দিয়েছেন ছ’শো কোটি টাকা। কেবল মদের শুল্ক থেকে এ রাজ্য আয় করে দশ হাজার কোটি টাকা। শিশুর খাবার কি তার একটু ভাগ পায় না? যে সরকার স্কুলভবন রং করতে দেড়শো কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, সে দিনে একটা ডিম দিতে পারে না?
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মধুমিতা দুবে বলেন, ডিম থেকে প্রতি গ্রামে প্রোটিন মেলে বেশি, আর তা শিশুর শরীর সহজে গ্রহণ করে। ডিমের প্রোটিন কোষকলা তৈরিতে সাহায্য করে। তা ছাড়া ডিম থেকে অ্যামাইনো অ্যাসিড মেলে, দেহের সঙ্গে বুদ্ধির বৃদ্ধিতেও যা বিশেষ সহায়ক। শিশু দিনে একটা ডিম খেলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে, প্রোটিনের চাহিদা মেটানো গিয়েছে।
সরকারের বাঁধা বুলি, সব কি স্কুল দেবে? মিড ডে মিল তো বাড়ির খাবারের উপরি। ‘সাপ্লিমেন্টারি’। ফাইলের ভাষা সরকারি ইস্কুলে এসে অর্থ হারায়। কর্মব্যস্ত মা চা-বিস্কুট, নইলে একটু মুড়ি খাইয়ে স্কুলে পাঠান শিশুকে। দুপুর একটার ভাতটুকু অধিকাংশ শিশুর প্রথম খাবার। ‘সাপ্লিমেন্ট’ আবার কী? যার দু’চারটে মুরগি আছে, সে ডিম বাজারে বেচে। ছেলেদের যদি বা একটা ডিম জোটে, মেয়েরা পায় অর্ধেক বা শূন্য।
শিশুর বেদনা কি শিক্ষকদের স্পর্শ করে না? করে বইকি। অনেক শিক্ষক পড়ুয়ার উপস্থিতি বাড়িয়ে দেখিয়ে, বাড়তি টাকায় ডিম জোগান। এটা ‘ওপেন সিক্রেট’। এই মিথ্যাচারে রাজি নন, এমন এক শিক্ষক জানালেন, দু’মাসে এক দিনও ডিম দিতে পারেননি। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সরকারই শিক্ষকদের চোর বানাচ্ছে।’’ বড় স্কুল, বেশি ছাত্র হলে তবু ‘ম্যানেজ’ করা যায়। ত্রিশ-বত্রিশ জন পড়ুয়া হলে সেটা অসম্ভব। জেলায় এত কম ছাত্র কোথায়? প্রত্যন্ত গ্রামে, দলিত-আদিবাসী এলাকার শিশু শিক্ষা কেন্দ্র, শিশু শ্রমিকদের ইস্কুলে, মাদ্রাসায়। দরিদ্রতম শিশুরা পুষ্টিতে সর্বাধিক বঞ্চিত।
সরকারি অফিসারও সকলে পাষাণহৃদয় তো নন। এক জেলাশাসক জানালেন, মিড ডে মিলের কত অনুদান কোন ব্যাঙ্কে পড়ে রয়েছে, কত সুদ জমেছে তার হিসেব নিয়ে, বিকাশ ভবনের অনুমোদন আনিয়ে, সে টাকাটা স্কুলগুলোকে বাড়তি অনুদান হিসেবে দেওয়া যায়। এ ভাবে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু স্কুলে নিয়মিত ফল দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রমী শিক্ষকও আছেন। গ্রামবাসীকে জড়িয়ে নিয়ে কেউ ‘পুষ্টি বাগান’ করছেন। কেউ নানা ভাবে টাকা জোগাড় করে ইলিশ, মাংস, আম, মিষ্টিও দিচ্ছেন। হোয়াটসঅ্যাপে সে সব ছবি ঘোরে। যে ছবি ওঠে না, তাতে জলবৎ ডাল, আলু-প্রধান তরকারি, আর সয়াবড়ির সামনে অপুষ্ট মুখের সারি। গণতন্ত্রের অনাথ সন্তান।
মার্গারেট থ্যাচার ব্রিটেনের শিক্ষামন্ত্রী হয়ে প্রাথমিক স্কুলে ফ্রি দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সরকারের খরচ কমবে। শিশুরা ছড়া বেঁধেছিল, ‘‘থ্যাচার থ্যাচার মিল্ক স্ন্যাচার।’’ ১৯ বছর পর যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, প্রস্তাব এল, শিশুবিভাগেও দুধ তুলে দেওয়া হোক। চল্লিশ লক্ষ পাউন্ড বাঁচবে। রাজি হননি থ্যাচার। নোটে লিখেছিলেন, ‘‘নিন্দার যে ঝড় সইতে হয়েছে, তার পর আবার?’’
একই শিক্ষা পান জয়ললিতা। ১৯৯৬ থেকে সপ্তাহে একটা ডিম পাচ্ছিল তামিল শিশুরা। ২০০১ সালে ডিম বন্ধ করে দেন জয়ললিতা। ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে হারের পর তড়িঘড়ি ফিরিয়ে দেন দুটো পরিষেবা, চাষিকে ফ্রি বিদ্যুৎ, আর মিড ডে মিলে ডিম। ২০০৬-এ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে করুণানিধি সপ্তাহে দু’দিন ডিম চালু করেন, ২০০৭ সালে তিন দিন, ২০১০ সাল থেকে পাঁচ দিন। ২০১১ সালে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা, কিন্তু শিশুর পাতের ডিমে হাত দিতে আর সাহস করেননি।
এ রাজ্যে শিশুরা হয়তো এক দিন ছড়া কাটবে, ‘‘মোদী বড় ধনকাতুরে, পাতের ডিম কেড়ে নিলে।’’ কিংবা, ‘‘দিদি বড় ভয় পেয়েছে, পাতের ডিম ফিরে দিয়েছে।’’ দু’টাকার চাল দিয়ে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পেলেন মমতা। লোকসভা ভোটের আগে ডিম কি পলিটিক্সে আসবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন