Budget 2020

আজ কঠিন পরীক্ষা নির্মলা সীতারামনের

জটিল পরিস্থিতির মধ্যে বাজেট পেশ করতে চলেছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর সামনে অনেকগুলি চ্যালেঞ্জ। দরকার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা। তিনি কি পারবেন সুদিনের পথ দেখাতে?

Advertisement

ভাস্কর গোস্বামী

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:০৪
Share:

প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী। ফাইল চিত্র

এক ভয়াবহ কঠিন পরিস্থিতিতে আর কয়েক ঘণ্টা পরে এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ হতে চলেছে। ইতিপূর্বে অর্থনীতির এই জটিল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি কোনও অর্থমন্ত্রীকে। এক দিকে, ঐতিহাসিক ভাবে বেড়ে চলা বেকারত্বের সমস্যা, অন্য দিকে দিনের পর দিন বেড়ে যাওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। স্বাধীনতার পরে এই প্রথম জিডিপি’র হার এত নীচে। শুধু তাই নয়, প্রায় সব উন্নয়নের সূচক নিম্নমুখী। অর্থনীতির ভাষায় স্ট্যাগফ্লেশনে আক্রান্ত দেশের অর্থনীতি। অর্থাৎ থমকে যাওয়া অর্থনীতিতে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি। এ অবস্থা বেশি দিন চললে অর্থনৈতিক মন্দা নিশ্চিত ভাবে দেখা দিতে পারে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, জেনে বুঝে হোক কিংবা অজান্তে, অর্থনীতির এই সমস্যাগুলি সরকারের ভুল নীতির মাশুল। শুরুটা হয়েছিল তিন বছর আগে নোট বাতিলের সেই ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত থেকে। ডিমোনিটাইজেশন বা নোটবন্দি দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রকে মৃতপ্রায় করে তুলেছিল। তার পরে তড়িঘড়ি জিএসটি রূপায়ণ ও ব্যাঙ্কিং শিল্পে বিপুল পরিমাণ জালিয়াতির ঘটনা অসংগঠিত ক্ষেত্রটিকে শেষ করে দেয়। ভুললে চলবে না যে, ভারতবর্ষের মতো উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় আয়ের অধিকাংশ আসে এই অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। সমস্যার গভীরতা আরও বাড়িয়ে তুলেছে ইদানীংকালের নাগরিক তত্ত্বের আইন তৈরির জন্য এক সামাজিক অস্থির পরিস্থিতি।

Advertisement

অর্থনীতির এই সমস্যা সমাধানের কোন যাদুমন্ত্র নেই। আবার সরকারের নীতিহীনতা নিঃসন্দেহে এই সমস্যা দীর্ঘায়িত করবে। তাই দরকার সুনির্দিষ্ট আগামীর রূপরেখা। যা এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট দিতে সক্ষম হলে ভবিষ্যতে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তার জন্য অর্থনীতির সমস্যার মূলে ঢুকতে হবে। বিচার করতে হবে সেই সমস্যার পরিধি ও ব্যাপ্তি। পর্যায়ক্রমে সেই সমস্যাগুলি নির্মূল করার দিশা দেখাতে হবে। তাই এ বারের কেন্দ্রীয় বাজেট এক চ্যালেঞ্জের বাজেট। এ বার দেখে নেওয়া যাক, সেই চ্যালেঞ্জগুলি কী এবং তার সমাধানের সম্ভাব্য রূপরেখা কী হতে পারে।

প্রথমেই আসে বিপুল বেকারত্বের সমস্যা ও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকা মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এই দুইয়ের যাঁতাকলে বাজারে চাহিদার অভাব। ফলে, জাতীয় আয় বৃদ্ধি তলানিতে নেমে যাওয়া। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র উপায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা ও মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো। নতুন কর্মসংস্থানের জন্য দরকার সরকারের তৈরি পরিকাঠামোগত বিনিয়োগ এবং বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের উৎসাহ প্রদান। পরিকাঠামো ও আবাসিক শিল্পে কর ছাড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে সরকারি ভর্তুকি অনেকাংশে এই ক্ষেত্রগুলোকে পুনর্জীবিত করতে পারে। কোষাগারের টাকা পরিকল্পিত ভাবে কাজে লাগালে আখরে অর্থনীতির লাভ হয়। অপরিকল্পিত ও অপ্রয়োজনীয় কাজ, যেমন, মূর্তি, মন্দির তৈরিতে সরকারি ব্যয়ে রাজনৈতিক মোক্ষলাভ হলেও কোনও সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক লাভ হয় না।

Advertisement

এর পরে দৃষ্টি দিতে হবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর উপায়ে। গরিব, প্রান্তিক ও মধ্যবিত্ত জনগণের ভোগব্যয়ের প্রবণতা সব সময়েই ধনী ব্যক্তিদের থেকে বেশি হয়। অর্থাৎ, এক টাকা আয় বৃদ্ধির ফলে গরিব ও প্রান্তিক মানুষেরা ওই বৃদ্ধির সিকিভাগই ভোগের উপর খরচ করে। কিন্তু সেই সমপরিমাণ আয় বৃদ্ধির জন্য ধনী ব্যক্তিদের ভোগব্যয়ের খুব একটা পরিবর্তন হয় না। এই সহজ, সরল তথ্যটি আমরা পাই অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তকে। একটি দেশের মোট অভ্যন্তরীণ চাহিদার একটি বিপুল অংশের উৎস হচ্ছে গ্রামীণ মানুষের ভোগব্যয়। তাই চাহিদা বৃদ্ধির জন্য দরকার গরিবের হাতে বেশি করে অর্থের যোগান। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে গরিব গ্রামীণ মানুষেরা এখনও অধিকাংশই কৃষিনির্ভর। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবে কৃষিক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়োজন রয়েছে। আশা রাখা যায় যে, এ বারের বাজেটে কৃষি ক্ষেত্রের বরাদ্দ অন্য বারের তুলনায় বেশি হবে। দরকার হয়ে পড়েছে গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি। ১০০ দিনের কাজ-সহ অন্য গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলির বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি অর্থনীতিকে অনেকটাই চাঙ্গা করে তুলতে পারে।

এর পরে বাজারের চাহিদার আর একটি মূল অংশের উৎপত্তি হয় চাকুরিজীবী, মধ্যবিত্ত জনগণের হাত ধরে। প্রায় বহু বছর ধরে আয়করের বিন্যাস অপরিবর্তিত থেকে গিয়েছে। এখন সময় এসেছে আয়কর নিয়ে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করার। আয় যুক্ত করের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানোর প্রয়োজন। আয়কর হারেরও পূর্ণবিন্যাস দরকার হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন আয়করের ৮০সি ধারার অধীনে থাকা সঞ্চয়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়ানো। সরকারের তরফে দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয়ে উৎসাহ দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা খুবই দরকার। এর ফলে এক দিকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে ও অন্য দিকে মানুষের সঞ্চয়ও বাড়বে। ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে চাহিদা বাড়বে আর অধিকতর দীর্ঘমেয়াদী সঞ্চয় সরকারি বিনিয়োগে সহায়তা করবে।

স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, কেন্দ্রীয় বাজেটের এই সব পদক্ষেপ করার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। এমনিতেই এখন রাজকোষের ঘাটতি ঐতিহাসিক ভাবে খুবই বিপদসীমার মধ্যে রয়েছে। তাই সন্দেহ জাগে যে, সরকারি ব্যয়ের লাগাম টানার জন্য আদৌ কি বাজেটে উপরে পদক্ষেপ করা হবে। প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই বিপুল পরিমাণ বাজেট বরাদ্দের টাকা আসবে কোথা থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যেই আরবিআই থেকে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়ে গিয়েছে। অনুমান করা যায়, এই ঋণের অধিকাংশই খরচ হয়ে গিয়েছে কর্পোরেট করের ছাড়ের ফলে রাজকোষের ঘাটতি মেটানোর জন্য। এ বার না হয়, সরকার আরবিআই থেকে ঋণ নিয়ে গরীব ও মধ্যবিত্তদের হাতে অর্থের যোগান বাড়ানোর ওপর নজর দিক।

সম্প্রতি অক্সফ্যাম-এর সমীক্ষায় জানা যায় যে, ভারতে ধনী ব্যক্তিদের হাতে জাতীয় আয় ও সম্পদের প্রায় ৮০ শতাংশ কুক্ষিগত হয়ে রয়েছে। অন্য দিকে, গরিব ও মধ্যবিত্তদের হাতে পড়ে আছে জাতীয় আয় ও সম্পদের বাকি অংশ। আয় ও সম্পদের এই বিপুল অসম বন্টন অর্থনীতির স্বাস্থ্যের জন্য মোটেই সুখবর নয়। আয় ও সম্পদের এই অসম বন্টন কিছুটা হলেও কমানোর সুযোগ রয়েছে এ বারের বাজেটে। এটা করা যেতে পারে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের সম্পদের উপর কর চাপিয়ে। তবে এর জন্য দরকার সরকারের কোলজের জোর, কারণ, এই বিত্তশীলরাই দলীয় নির্বাচনী তহবিল ভরিয়ে তোলে।

আরটিআই আর সংবাদপত্রের সূত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারে প্রচারের জন্য, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বিদেশ যাত্রার জন্য। আর নতুন নাগরিকত্বের আইন প্রণয়নের জন্য আরও কোটি কোটি টাকা খরচ হতে চলেছে। অনুমান করা যায় যে, প্রত্যেক প্রমাণিত দেশবাসীর জন্য আবার নতুন করে নাগরিক পরিচয়পত্র তৈরির খরচ রাজকোষকে প্রায় শূন্য করে দেবে। তাই প্রশ্ন জাগে পরিচয়পত্র আগে, না কি হাতে কাজ ও পেটে ভাত আগে।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন