চলছে গোলাপ কেনা। দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারে। বুধবার। ছবি: বিকাশ মশান
‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’ উদ্যাপনের পিছনে যে ঐতিহাসিক পেক্ষাপট আছে তা খুবই রহস্যময়। ইতিহাসের পাতায় আমরা দু’জন ভ্যালেনটাইনের উল্লেখ পাই। সেন্ট ভ্যালেনটাইন বলে এক রোমান পুরোহিত ছিলেন, যিনি রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের যুদ্ধনীতির প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। দ্বিতীয় ক্লডিয়াস মনে করতেন, অবিবাহিত পুরুষেরা যোদ্ধা হিসেবে বেশি কার্যকরী ও শক্তিশালী, বিবাহিত পুরুষদের তুলনায়। তাই তিনি, অল্পবয়সী পুরুষদের বিবাহ নিষিদ্ধ করেছিলেন। সেন্ট ভ্যালেনটাইন এই প্রথার প্রবল বিরোধিতা করেছিলেন। লুকিয়ে প্রেমিক যুগলদের বিয়ের ব্যবস্থা করতেন তিনি। পরে দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তা জানতে পেরে, সেন্ট ভ্যালেনটাইনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁকে হত্যা করা হয়। সেই থেকে ওই দিনটি ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’ অর্থাৎ প্রেমিক, প্রেমিকার ভালবাসার দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আবার অন্য একটি সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি, সেন্ট ভ্যালেনটাইন খ্রিস্টানদের রোমান সম্রাটের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছিলেন। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী, সেন্ট ভ্যালেনটাইন যখন জেলে বন্দি ছিলেন, তখন খুব সম্ভবত এক জেল অধিকর্তার কন্যার প্রেমে পড়ে যান। এবং তিনি একটি প্রেমপত্র লেখেন। যেখানে সেই প্রেমিকার প্রতি ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেনটাইন’ বাক্যবন্ধটির উল্লেখ ছিল। তাঁকেও ১৪ ফেব্রুয়ারি হত্যা করা হয়। সেই থেকে না কি, ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’ প্রেমিক, প্রেমিকার ভালবাসার দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। উৎস নিয়ে মতান্তর চলতে থাকুক, বাস্তবে সমস্যা হচ্ছে এই ভালবাসার প্রকাশ কী ভাবে হবে? শুধু মুখের কথায় তো চিঁড়ে ভিজবে না।
তাই খুব স্বাভাবিক ভাবে ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’-এর সঙ্গে উপহারের প্রসঙ্গ চলে আসে। হৃদয়ের কাছাকাছি থাকা মানুষটির জন্য একটি রুচিশীল ও উপযুক্ত উপহার খোঁজা বেশ কঠিন কাজ। যদিও এই রীতি পাশ্চাত্য সভ্যতার অঙ্গ, কিন্তু আমাদের দেশও এ বিষয়ে খুব একটা পিছিয়ে নেই। এটি মূলত সম্ভব হয়েছে বিশ্বায়নের ফলে। যার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সীমানা ঘুচিয়ে জিনিসপত্র ও শ্রমের অবাধ যাওয়া আসা। এই জিনিসপত্র, শ্রম ও শ্রমিকের আসা যাওয়ার মাধ্যমেই বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়। আর এরই হাত ধরে আমাদের ঘরে ঢুকে গিয়েছে বিভিন্ন দিন উদ্যাপনের রীতি। মাদার্স ডে, ফাদার্স ডে, ভ্যালেনটাইন্স ডে’র মতো আরও অনেক ‘ডে’র কথা এখন নতুন প্রজন্মের মুখে মুখে ঘোরে।
আমেরিকায় একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই ভ্যালেনটাইন্স ডে উপলক্ষে সবচেয়ে বেশি চকলেট, গ্রিটিংস কার্ড ও ফুল বিক্রি হয়। তার পরে স্থান সোনা ও হীরের অলঙ্কারের। সমীক্ষার এই ফলাফল থেকে বোঝা যায় যে, প্রেমিক, প্রেমিকার উপহার হিসেবে প্রথম পছন্দ চকলেট, তার পরে গ্রিটিংস কার্ড ও ফুল, বিশেষ করে গোলাপ। ওই সমীক্ষায় এও দেখা গিয়েছে, যে ভ্যালেনটাইন্স ডে তে রেস্তোরাঁ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। সমীক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা যায় যে, প্রবীণ নাগরিকের তুলনায় সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকেরাই বেশি করে এই ভ্যালেনটাইন্স ডে পালন করেন। আবার এই সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে ভ্যালেনটাইন্স ডে’র উদ্দীপনা প্রবল ভাবে লক্ষ করা যায় অবিবাহিত বা সম্ভাব্য যুগলদের মধ্যে। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিতে থাকা স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে। মনে রাখতে হবে যে, এই সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক পড়ুয়ারা কর্মহীন। তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা কম। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই, উপহারের তালিকায় থাকে চকলেট, গ্রিটিংস কার্ড ও গোলাপ।
সমীক্ষার এই প্রবণতাটি আমাদের দেশও লক্ষ করা যায়। যদিও স্মার্টফোন ও হোয়াটসঅ্যাপের যুগ, গ্রিটিংস কার্ড আদান-প্রদানের প্রথাটিকে মৃতপ্রায় করে ফেলেছে। তাই এখন ওই দিনটিতে চকলেট ও ফুলের ব্যবসার রমরমা। খুচরো ব্যবসায়ীদের সময়টা ভালই যায়। আর একটু উচ্চ-স্বচ্ছল পরিবারে সোনা, হীরের অলঙ্কার তো আছেই। বিভিন্ন গয়না প্রস্তুতকারী সংস্থা, এই সময়ে ছাড় দিয়ে ক্রেতা টানতে চান। এই সময় তাদের ব্যবসারও ‘মধুমাস’। এর সদর্থক প্রভাব তো অর্থনীতিতে পড়বেই।
কিন্তু উপহার বাছার সময়ে, প্রেমিক বা প্রেমিকার মন কী ভাবে কাজ করে? কী ভাবে সে উপহার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়? অর্থনীতিতে এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থনীতি বলে, উপহারের মাধ্যমে প্রাপকের কাছে একটি সঙ্কেত যায়। অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে বলা হয়, ‘সিগন্যালিং স্ট্র্যাটেজি’। এই ‘সিগন্যালিং স্ট্র্যাটিজি’ উৎপত্তি হয়, ‘অ্যাসিমেট্রিক ইনফরমেশন’ বা তথ্যের অসাম্যের উপরে। অর্থাৎ এক জন, অন্য জনের ভাললাগা, মন্দলাগা সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নাও থাকতে পারেন। আবার এক জন মনে মনে এমন একটি উপহার প্রত্যাশা করেন, যা অন্য জন অনুমান করতে পারে না। এই পছন্দের ভিন্নতা বস্তুবাদী নাও হতে পারে। মানে প্রেমিক পছন্দ করেন লাল গোলাপ দিতে, কিন্তু প্রেমিকার লাল রঙে অ্যালার্জি। তাঁর পছন্দ গোলাপি গোলাপ!
আবার ধরা যাক প্রেমিক, তাঁর প্রেমিকাকে দামি হীরের অলঙ্কার উপহার দিলেন। আবার উল্টোটাও হতে পারে। এটিও একটা সিগন্যালিং স্ট্র্যাটেজি। কারণ, উপহারের মূল্যের মাধ্যমে প্রেমিক জানিয়ে দিতে সক্ষম হয় তাঁর জীবনে প্রেমিকার মূল্য। এ দিকে প্রেমিকার মনেও একটি প্রত্যাশার জন্ম নেয়, হয়তো আগামী ভ্যালেনটাইন্স ডে’র উপহারে এর থেকেও দামি উপহার মিলবে। তবে বাস্তবে সব ক্ষেত্রে এটি সত্যি হয় না। উপহারের দাম দিয়ে সব কিছু বিচার করা ঠিক নয়। তাই যদি হত, তা হলে নগদ অর্থ, উপহার হিসেবে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকত। আসলে জীবনের কিছু ক্ষেত্রে, নিষ্পত্তি বিচারবুদ্ধি সম্পন্ন নাও হতে পারে। অর্থনীতির ভাষায় যাকে অযৌক্তিক ব্যবহার (ইর্যাশনাল বিহেবিয়ার)। উপহারের অন্তর্নিহিত মূল্যটিই যেখানে আসল বিচার্য। আবার ভ্যালেনটাইন্স ডে’র উপহারের একটি প্রতি-উপহারের সম্ভাবনা থাকে, যাকে বলা হয় রেসিপ্রসিটি। এই ক্ষেত্রে উপহার কৃতজ্ঞতা ঋণে আবদ্ধ করে অন্য জনকে।
অন্য দিকে, এই উপহার বাছাইয়ের ব্যাপারে বড় ভূমিকা নেয় বিজ্ঞাপন। আসলে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ভাষা ও তার আকর্ষণীয় প্রেক্ষাপট অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে উপহার বাছাইয়ের উপরে। তৈরি করতে পারে কৃত্রিম চাহিদা। যেখানে বাজারচলতি বা ট্রেন্ডিং উপহার নির্বাচন করাই রীতিমতো দস্তুর হয়ে ওঠে। কারণ, সবাই চায় সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে, সময়োপযোগী হয়ে উঠতে। তবে, যে দেশে কয়েকটি সরকারি পদের জন্য লক্ষ লক্ষ যুবক, যুবতী আবেদন করেন, সেখানেই এই দিনটি সত্যই কোনও তাৎপর্য আছে কি না, সে সম্পর্কে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক