শপথ: উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব মৌর্য, বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লখনউ, ১৯ মার্চ। পিটিআই
১৯২৫ সালে আরএসএসের জন্ম। ওই বছরেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিরও জন্ম। মোহন ভাগবত দিওয়ার-এর অমিতাভ বচ্চনের স্টাইলে প্রকাশ কারাটকে বলতে পারেন, ‘পুরি দেশমে আজ দেখো, তুম কহাঁ হো অউর ম্যায় কহাঁ হুঁ।’
শুধু কমিউনিস্টরাই বা কেন, নেহরু-গাঁধী পরিবারের উত্তরপ্রদেশে আজ নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে গৈরিক পতাকার দাপট দেখে তাকে হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতার বিজয় আর ধর্মনিরপেক্ষতার বিপর্যয় বলে অশ্রুপাত করছেন যে সেকুলারপন্থীরা, তাঁদেরও একই কথা বলা যায়।
তবে তার আগে আমার প্রশ্ন, হে সেকুলারপন্থী, আপনারা কারা? আপনারা তাঁরাই যাঁরা ভারতে ‘সেকুলারিজম’-কেও হিন্দুত্বর মতোই একটা পালটা ধাঁচা বানিয়ে দিয়েছেন। বীর সাভারকরের ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’ যে সনাতন হিন্দু ধর্মেরই শত্রু, সেটা বুঝলে এবং বোঝাতে পারলে বোধ হয় এই ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতার মেকি-বিতর্কটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেত আজকের নতুন ভারতে। সাভারকর নিজে ঈশ্বর-বিশ্বাসী ছিলেন না। কেশব বলিরাম হেড়গেওয়ার সাভারকরের বিরোধিতা করেন। আরএসএস হিন্দু মহাসভা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে। তিনি রাজনৈতিক হিন্দুত্বের চেয়ে সাংস্কৃতিক হিন্দুত্বে জোর দেন। কিন্তু আজ এত বছর পর মোদী-শাহ হাঁটছেন সাভারকরের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের কট্টরবাদী পথে। তার সঙ্গে মিশিয়েছেন একত্ববাদী ভারতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিতে হিন্দু-জাতি রাষ্ট্রগঠনের লক্ষ্য।
কলেজ জীবনে হাওড়ার শিবপুরের মন্দিরতলায় আমাদের গানের টিম ছিল। জেলায় জেলায় গান গেয়ে বেড়াতাম। বামপন্থীরা বলতেন গণসঙ্গীত। জাতীয়তাবাদীরা বলতেন, বৃন্দগান। এক বার সিদ্ধান্ত হল, শুধু পল রবসন নয়, সামবেদের গানও গাইব। সংগচ্ছধ্বম্ সংবদধ্বম্...। জ্যোতিবাবুর জমানা তখন। আমাদের বেদগানে বামপন্থীরা গেলেন বেদম চটে। আমরা বলেছিলাম, বেশ করব আমরা সামবেদের সাম্যের গান গাইব। শুধু সলিল-হেমাঙ্গ গাইব, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে?
কিছু দিন আগের কথা। শিবগঙ্গা এক্সপ্রেসে দিল্লি থেকে বারাণসী যাচ্ছি। আমি বঙ্গসন্তান, রাতে খাচ্ছি মুরগির ঝোল। পাশে বসে টিকিধারী এক জোশীজি নিরামিষ রুটি-পনির খাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে বিপরীতে বসা এক মার্কিন পর্যটক পণ্ডিতজিকে বললেন, ইউ আর হিন্দু ভেজিটেরিয়ান। ইউ আর রাইট-উইং। আর আমি হলাম নন-ভেজিটেরিয়ান লেফট উইং! কী কাণ্ড! আমরা দুজনেই ভারতীয়। আমিষ-নিরামিষ খাওয়ার সঙ্গে ভারতের রাজনীতির সম্পর্ক নেই, সেটা বোঝাতেই আমার কালঘাম ছুটে গিয়েছে।
বিজেপির নীল-নকশা হল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকায় গৈরিক পতাকা উড্ডয়ন করা। হিন্দু সমাজকে সুসংহত করতে দলিত ও নিম্নবর্গকে হিন্দু-সমাজের গাড়িতে তুলে নেওয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠের হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠায় আজ সঙ্ঘ পরিবার সফল হচ্ছে এই পালটা সেকুলারপন্থীদের জন্য। যাঁরা গলার শিরা ফুলিয়ে গো-মাংস ভক্ষণকে ধর্মনিরপেক্ষতার ছাড়পত্র বলে ঘোষণা করেন। সরস্বতী বন্দনা নামক বিষয়টিতেই যাঁদের নাক সিঁটকানো অ্যালার্জি। ইফতার পার্টিতে টুপি পরে নামাজ পড়লে তাঁদের বেশি ধর্ম করছি মনে হয় না, বরং পলিটিক্যালি কারেক্ট মনে হয়। কলেজ জীবনে আমাদের কিছু নকশাল বন্ধু হিন্দু হস্টেলে গীতা না ছুঁয়ে রেড বুক ছুঁয়ে বিয়ে করল। তার পর অতিথিদের দেওয়া হল নিজামের বিফ রোল। এই সেকুলার দৌরাত্ম্যেই মুদ্রার অপর পিঠে হিন্দুত্বর বাড়বাড়ন্ত, এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার সময় এসেছে কমরেড!
আচ্ছা বলুন তো, সম্রাট অশোক কি ‘সেকুলার’ ছিলেন? সম্রাট আকবর? এই দুই সম্রাট, এক জন বৌদ্ধ, অন্য জন মুসলিম, দুজনেই ‘সেকুলার’ শব্দটি শোনেননি। সোনার কেল্লার ডক্টর হাজরার স্টাইলে ওঁদের দুজনকে যদি প্ল্যানচেট করেন, আমি নিশ্চিত ওঁরা দুজনেই বলবেন, ভাই, আমরা দুজনেই সেকুলারপন্থী-টন্থী নই। আসলে বৌদ্ধ-ইসলাম দর্শন দুজনকেই পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। তাই দিন-ই-ইলাহি বা ধম্মপদ ছিল মানুষ-কেন্দ্রিক।
সংসদের সেলস কাউন্টারে অশোক স্তম্ভ বিক্রি হয়। কিন্তু আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা ভারতের শিকড় থেকে আহরণ না করে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র আর গির্জার সংঘাতে সৃষ্ট খ্রিস্টধর্ম প্রভাবিত ইউরোপীয় সেকুলারিজম থেকে ‘টুকলি’। নেহরু-গাঁধী দেশভাগ মানতে বাধ্য হন ব্যথিত চিত্তে। কিন্তু দেশভাগ মেনে নিয়েও কংগ্রেস জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বকে মানেনি। আর আজকের ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ সেই সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। নেহরু-গাঁধীর ভারত চেতনার ‘কাউন্টারফ্যাক্টস’ তৈরি করতে তাই আসরে নেমেছেন তিনি। রাজনৈতিক হিন্দুত্বই আধুনিক ভারতের পাসওয়ার্ড। এই হিন্দুত্বই হিন্দু ভাবনার বড় শত্রু।
জন্মসূত্রে আমি ব্রাহ্মণ। কিন্তু হিন্দু সমাজ আমাকে পইতে পরতে বাধ্য করে না। এখনও পর্যন্ত সমাজপতিরা এমন কোনও ফরমান জারি করেনি যেখানে বলা হয়েছে নামাজের মতো আমাদের পাঁচ বার গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করতে হবে। ইসলামিক আচরণবিধির মতো অনুশাসনের অক্টোপাসের বাহুডোরে বাঁধতে চাইছে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। বলতে হবে, ভারতবর্ষ আর্য ভূমি, এক জাতি। ভারতীয়ত্ব নানা জাতির এক ‘অসমসত্ত্ব ফ্লুইড’ বললে আমাকে ধরে মারবেন? আর্যরা ‘বিদেশি’ বলা যাবে না। শুধু মুসলিম শাসকরাই ছিলেন বিদেশি আক্রমণকারী। যদি বলি, বরং ব্রিটিশরা এখানে উপনিবেশ বানালেও ম্যাকলে পুত্ররা এখানে স্থায়ী ভাবে যতটা বসবাস করতে চেয়েছেন, আকবর-আওরঙ্গজেব তার চেয়ে বেশি ভারতে বসবাস করতে চেয়েছেন? সে তো ছিল ভারতেরই শাসন।
পাকিস্তান মুসলমান সত্তা বাদ দিলে আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে। আমাদের ছিল বিবিধের মাঝে মিলন-মহান। দেশভাগের প্রতিবাদে বিহারের মুসলমান সমাজের বিদ্রোহ ঐতিহাসিক সত্য। যোগীরাজের মুখ্যমন্ত্রী পদে অভিষেক দেখে মনে হচ্ছে মোদী-অমিত শাহের ভারত নামক এই ‘মেল্টিং পট’টা পছন্দ নয় একদমই।
সময় এসেছে বিরোধী নেতাদের আজ একজোট হয়ে অন্তত এই কথাটুকু বলার যে, ভারত একটা ধর্ম, একটা সংস্কৃতির দেশ নয়। দোহাই, ভারতটাকে আপনারা পাকিস্তান হতে দেবেন না। তা হলে এ দেশেও ধর্মান্ধতার অনুশাসনকে আহ্বান জানাব। যোগী আদিত্যনাথ ভারতের এই বৃহত্তম গণতন্ত্রের হত্যার কারণ যেন না হন, এটাই প্রত্যাশা।