সম্পাদকীয় ১

একা নায়ক

পাকিস্তানে বাজি পুড়িয়াছে কি না, অমিত শাহ বলেন নাই। কিন্তু দীপাবলির পূর্বলগ্নে দিল্লির রাইসিনা রোডে মুরলীমনোহর জোশীর বাসভবনে যে বিস্ফোরণ ঘটিল, তাহার শব্দ কিলোমিটার খানিক দূরত্ব পার করিয়া অশোক রোডে শাহি দফতরে বিলক্ষণ পৌঁছাইয়াছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:১৬
Share:

পাকিস্তানে বাজি পুড়িয়াছে কি না, অমিত শাহ বলেন নাই। কিন্তু দীপাবলির পূর্বলগ্নে দিল্লির রাইসিনা রোডে মুরলীমনোহর জোশীর বাসভবনে যে বিস্ফোরণ ঘটিল, তাহার শব্দ কিলোমিটার খানিক দূরত্ব পার করিয়া অশোক রোডে শাহি দফতরে বিলক্ষণ পৌঁছাইয়াছে। নরেন্দ্র মোদী যাঁহাদের মার্গদর্শক মণ্ডল নামক বানপ্রস্থে পাঠাইয়াছিলেন, বিহারে ভরাডুবির পর তাঁহাদের প্রত্যাঘাতটি মোক্ষম। এবং, তাহার সময়টিও নির্বিকল্প। নির্বাচনী ভরাডুবির ক্ষতে অরুণ জেটলি সংস্কারের মলম লাগাইবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লালকৃষ্ণ আডবাণীরা কাহারও নাম উল্লেখ না করিয়াই মোদী-শাহ-জেটলির ত্রিমূর্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইয়া দিলেন। জেটলির ক্ষণজীবী সংস্কার সেই বিস্ফোরণে উড়িয়া গেল। এই কিল হজম করা ভিন্ন আপাতত তাঁহাদের আর কিছু করণীয় নাই। কারণ, আডবাণীরা তাঁহাদের যে দফায় কাঠগড়ায় তুলিয়াছেন, তাহার বিপক্ষে পেশ করিবার যুক্তি তাঁহাদের হাতে নাই। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অসহিষ্ণুতার। এত দিন যে অভিযোগ প্রথমে বিরোধী দলগুলির মুখে এবং পরে নাগরিক সমাজের কণ্ঠে শোনা যাইতেছিল, এই বার সেই অভিযোগই দলের কেন্দ্র হইতে উঠিয়া আসিয়াছে— তাঁহারা ভিন্ন স্বরকে জায়গা করিয়া দিতে প্রস্তুত নহেন। অরুণ শৌরির কথায়, মোদী-শাহ-জেটলি ত্রয়ীই বর্তমানে বিজেপি-র সমস্ত সিদ্ধান্তের অধিকারী। দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়াছে। রাইসিনা রোডের বিদ্রোহ তাহারই প্রতিক্রিয়া।

Advertisement

আডবাণী-জোশী-শৌরিদের এই বিদ্রোহের পিছনে ব্যক্তিগত কারণ কতখানি, সেই প্রশ্নটিকে উড়াইয়া দেওয়ার উপায় নাই। মোদী জমানায় তাঁহারা যে ভাবে কোণঠাসা হইয়াছেন, তাহাতে অনুমান করা চলে, তাঁহারা হয়তো প্রত্যাঘাতের সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। বিহারের বিপর্যয় সেই সুযোগ আনিয়া দিয়াছে। কিন্তু, সেই কারণটিও তাঁহাদের অভিযোগের গুরুত্ব হ্রাস করে না। বিজেপি-র ক্ষেত্রে প্রশ্নটি গুরুতর, এবং কিঞ্চিৎ দুর্ভাগ্যজনকও বটে। কারণ, দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বিজেপি ভারতের অন্যান্য বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলির তুলনায় বহু কদম আগাইয়া ছিল। মোদী-শাহ জমানায় দৃশ্যতই তাহাতে ভাটা পড়িয়াছে। মার্গদর্শক মণ্ডল তৈরি হইয়াছে বটে, কিন্তু তাঁহাদের নিকট কখনও কোনও পরামর্শ চাওয়া হইয়াছে বলিয়া অভিযোগ নাই। সংসদীয় দলের বৈঠকও ক্রমে তাৎপর্যহীন হইয়াছে। বিজেপি আর মোদী-শাহ জুটি ক্রমে সমার্থক হইয়াছে। বিহারের নির্বাচন তাহারই প্রমাণ। সেখানে দলের কোনও ঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন না। মোদীই ছিলেন দলের মুখ। গণতন্ত্র আর ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা হাত ধরিয়া চলে না।

দেড় বৎসরে বিজেপি যে পথে হাঁটিয়াছে, তাহা কংগ্রেসের পথ। সেই দলে যেমন ১০ জনপথই প্রথম এবং শেষ কথা, বিজেপিও ক্রমে ৭ রেসকোর্স রোড-কেন্দ্রিক হইয়াছে। কোন দল কী ভাবে চলিবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতান্তই দলের। কিন্তু, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আসিয়া গণতন্ত্রকে লইয়া গেলে যে তাহার ফল সুখপ্রদ হয় না, নরেন্দ্র মোদীরা সম্ভবত তাহা টের পাইতেছেন। যে দুনিয়ার সহিত তাঁহার পরিচিতি বিস্তৃত, নরেন্দ্র মোদী সেই কর্পোরেট জগতের দিকেও তাকাইতে পারেন। সেখানে বহু সফল সংস্থাতেই এখন সিইও-ই প্রধান, কিন্তু একমাত্র নহেন। তাঁহাকেও বিভিন্ন মাপের ম্যানেজারদের সঙ্গে লইয়া চলিতে হয়। সংস্থার স্বাস্থ্যের পক্ষেই তাহা জরুরি। গুজরাতের রাজনৈতিক মডেলে অভ্যস্ত মোদী ও শাহ কি বিহারের ধাক্কা হইতে সবাইকে লইয়া চলিবার শিক্ষাটি গ্রহণ করিতে পারিবেন? তাঁহাদের চলিবার, এবং চালাইবার, ভঙ্গি বদলাইবে? না কি, ‘একা নায়ক’ হইবার বাসনা তীব্রতর?

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন