যা বলছে আমরুহাঁসা নদী

ভারতেরই একটা শহর জল না পেয়ে তেষ্টায় গলা ফাটাচ্ছে। বৃষ্টি চেয়ে হইচই হচ্ছে। লোকে বলছে, পানীয় জল ফুরিয়ে আসছে। জল বাঁচাও। নদী বাঁচাও। আর এখানে এক জলজ্যান্ত নদীকে ধীরে ধীরে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলছে কিছু মানুষ। আমরুহাঁসার কথা শুনলেন নয়ন মুখোপাধ্যায় ভারতেরই একটা শহর জল না পেয়ে তেষ্টায় গলা ফাটাচ্ছে। বৃষ্টি চেয়ে হইচই হচ্ছে। লোকে বলছে, পানীয় জল ফুরিয়ে আসছে। জল বাঁচাও। নদী বাঁচাও। আর এখানে এক জলজ্যান্ত নদীকে ধীরে ধীরে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলছে কিছু মানুষ। আমরুহাঁসার কথা শুনলেন নয়ন মুখোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৯ ০২:৫৮
Share:

আমরুহাঁসার জলের এখন এমনই হাল। —নিজস্ব চিত্র

আজ ভেবে গর্ব বোধ হচ্ছে যে, ১২টি গ্রামের বাসিন্দারা তাঁদের ‘মা’কে (আমরুহাঁসা নদীকে) বাঁচানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হলেন। আন্দোলন করলেন। অবরোধে স্তব্ধ করে দিলেন জাতীয় সড়ক। প্রশাসন নড়েচড়ে বসল। বড় বড় অফিসবাবুরা ছুটে এলেন ওঁদের কথা শুনতে। বললেন, আর অন্তত দেড়টা মাস ধৈর্য ধরুন ওঁরা। এর মধ্যেই নদীমাতৃকার জরামুক্তি হবে। এ কথা শুনে মন ভরে এল।

Advertisement

হ্যাঁ, আমার নাম আমরুহাঁসা, অযোধ্যার কানাপাহাড় থেকে নন্দুডি, মাইতিডি, বনডি, নদুডি, নামশোল, ছাতাটাঁড়, তেঁতুল, ছোলাগোড়া, আমরুহাঁসা গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছি। এই গাঁয়ের লোকগুলো আমার ছেলেমেয়ের সমান। এদের আমি লালনপালন করি, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমার কাছে এলে বুকে টেনে নিই ।

এত দিন বেশ ভালই চলছিল। সুস্থ ছিলাম। কোনও বিষ, অসুস্থতা ছিল না আমার শরীরে। আশপাশের ১২-১৫টি গাঁয়ের মানুষ আমার জল ব্যবহার করতেন। গাঁয়ের গৃহপালিত পশুর পানীয়ের জল, গৃহস্থের রান্নার জল, স্নানের জল, কখনও কখনও চাষের জলও আমার বুক থেকেই নিতে হত ওঁদের। মাছ ফলত জলে।

Advertisement

কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল, আমার জল পান করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে গ্রামের গবাদি পশুরা। তাদের পাতলা পায়খানা হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে। বাবুরা সব খেয়াল করলেন, জলের রঙ কোথাও লাল, আবার কোথাও বা কালো। শরীর ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে আমার। আমার জলের সন্তানেরাও মারা যাচ্ছে। এক সময় আমার দু’পাশে নরম সবুজ ঘাসের গালিচা পাতা ছিল। এখন ওদের কী রোগ হয়েছে জানি না, তাদের শরীর সব লাল হয়ে যাচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যেই শুকিয়ে যাচ্ছে সে গালিচা।

এক সময় গ্রামের প্রায় সবাই দিনের ক্লান্তি শেষে আমার জলের কাছে আসতেন। হাপুসহুপুস করে স্নান করতেন। কিন্তু এখন আমার জল ওদের কাছে বিষ। শুনছি, এই আমরুহাঁসা নদীতে স্নান করে অনেকের চামড়ার রোগ হচ্ছে, চুল উঠে যাচ্ছে, পেটে ব্যথা থেকে রোগভোগ তো রয়েছেই। ভেবে নিজেরই লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে।

বাবুরা সব দেখেশুনে নিশ্চিত হলেন, গালা-শিল্প কারখানা থেকে দূষিত নোংরা জল ফেলা হচ্ছে আমার শরীরে। আর তাতেই দিন দিন রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ছি আমি। অযোধ্যার আমরুহাঁসা নদী।

অভিযুক্তদের সতর্ক করা হল। কাজ হল না। প্রশাসনকেও জানানো হল। কাজ হল না। প্রায় এক বছর টানা দৌড়ঝাঁপ আন্দোলন-আওয়াজ করেও দূষণ কমাতে পারলেন না আমার ছেলেমেয়েরা। শেষে ২০১৮ সালে ডিসেম্বর মাসে ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞানমঞ্চ’-এর জেলা সম্মেলনে বিষয়টা নিয়ে কথা বললেন সবাই। ঠিক করা হল, এ বার সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়বেন আমায় সুস্থ করতে। নদীর জল পরীক্ষা করতে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতার পরীক্ষাগারে।

পরীক্ষায় জানা গেল, জলে ভীষণ রকম দূষিত পদার্থ রয়েছে। সে সব জানানোও হল প্রশাসনের কাছে। জেলা প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন দূষণ বন্ধের আশ্বাস দিল। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের অভিজ্ঞতা, তার পরেও কাজ আর তেমন হল না।

ভাবতে অবাক লাগে। এই ভারতেরই একটা শহর জল না পেয়ে তেষ্টায় গলা ফাটাচ্ছে। বৃষ্টি চেয়ে হইচই হচ্ছে। লোকে বলছে, পানীয় জল ফুরিয়ে আসছে। জল বাঁচাও। নদী বাঁচাও। জল সংরক্ষণ করো। আর এখানে এক জলজ্যান্ত নদীকে ধীরে ধীরে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলছে কিছু মানুষ।

আমার ছেলেমেয়েরা বললেন, পরীক্ষায় জলে নাকি প্রচুর পরিমাণ ‘কলিফর্ম ব্যাকটিরিয়া’ পাওয়া গেছে। এই জীবাণু থাকার মানেই নাকি সেই জল ভয়ঙ্কর ভাবে দূষিত। এই জীবাণু থেকেই ডায়রিয়া হয়। জলে সিসা, লোহা বিপজ্জনক মাত্রার থেকে বেশি থাকলে তা বাচ্চাদের মস্তিষ্কের বিকাশ বাধা দেয়। লিভার, কিডনি, প্যানক্রিয়াস— এই দুই মৌলের জন্য ভয়ঙ্কর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জল পরীক্ষকেরা নাকি বলেছেন, জলে লাক্ষা ধোয়া অ্যাসিড ও অন্য রাসায়নিক দ্রব্য পড়ে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। তাই জলের গাছ, জলের মাছ মরে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিককে বিজ্ঞানমঞ্চের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। কিন্তু লাভ হয়নি। কাঠফাটা গরমে গ্রামের মানুষ ভয়ে ভয়ে সেই বিষ জলই ব্যবহার করতে থাকে।

শেষে ওরা উপয়ান্তর না দেখে এই অবরোধের পথ বেছে নিল। মনে হতেই পারে, অবরোধ করাটা ঠিক হল কি? আর পাঁচ জনের অসুবিধা করে! কিন্তু ভাবলাম, কোনও কিছু জোর করে শোনাতে গেলে তো কড়া পদক্ষেপের দরকার পড়ে কখনও সখনও। এলাকার বিজ্ঞানমঞ্চ, আদিবাসী লোকশিল্পী সংঘও ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সবাই মিলে আমাকে আমরুহাঁসা নদীকে বাঁচানোর জন্য এক সুরে কথা বলেছে।

অভিজ্ঞতা বলে, প্রশাসন কোথাও কোথাও মানুষের অতিরিক্ত জল ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা লাগিয়েছে বটে, কিন্তু ঠান্ডা পানীয় তৈরির সংস্থাগুলোকে লক্ষ লক্ষ গ্যালন জল ব্যবহার করতে দিচ্ছে এমন অভিযোগও রয়েছে। শিল্পের কলকারখানাতেও একই অবস্থা। তার উপরে অনেক কারখানাই দূষিত পদার্থ শোধন না করেই নদীর জলে ফেলায় অভিযুক্ত। অথচ, এই নদীগুলোই তো গ্রামগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নদী না বেঁচে থাকলে, সুস্থ থাকলে মানুষও পৃথিবীতে থাকবে না। আরও এক বার মনে করার সময় এসে গিয়েছে যে, ভারত একটা নদীমাতৃক দেশ।

লেখক পুরুলিয়ার চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন