প্ররোচনার নানা উপকরণ হাতের সামনে মজুত

সর্বনাশ রুখতে চাই শুভবুদ্ধি

মহাধুমধাম করে রথযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছিল বিজেপি। তাদের ঘোষিত সূচি অনুযায়ী কোচবিহার, কাকদ্বীপ ও তারাপীঠ থেকে একই রকম ভাবে সাজানো তিনটি বাসে বিজেপির বড় বড় নেতারা রাজ্য সফর করবেন।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:২১
Share:

পথে নামার আগেই থমকে গেল বিজেপির রথ। কথা ছিল আজ রথের যাত্রা শুরু হবে কোচবিহার থেকে। সূচনায় উপস্থিত থাকবেন অমিত শাহ। কিন্তু বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টের একটি নির্দেশে তা ধাক্কা খেল। এই রায়ের বিরুদ্ধে বিজেপি আবার আদালতের দ্বারস্থ হতে চেয়েছে। দলের দাবি, আজ, শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে তাদের আর্জি শোনা হবে। সে ক্ষেত্রে এই কর্মসূচির ভবিতব্য আপাতত আদালতের বিচারসাপেক্ষ হয়ে গেল। ফলে আজই রথযাত্রা শুরু করা যাবে কি না, সেই অনিশ্চয়তা এখনও বহাল।

Advertisement

মহাধুমধাম করে রথযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছিল বিজেপি। তাদের ঘোষিত সূচি অনুযায়ী কোচবিহার, কাকদ্বীপ ও তারাপীঠ থেকে একই রকম ভাবে সাজানো তিনটি বাসে বিজেপির বড় বড় নেতারা রাজ্য সফর করবেন। ঘোষণা অনুযায়ী, মাস দেড়েকের এই রথযাত্রায় নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ থেকে শুরু করে যোগী আদিত্যনাথ, ত্রিপুরার বিপ্লব দেব, এমনকী অসমের নাগরিকপঞ্জি-খ্যাত মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনওয়াল— সবাই যোগ দেবেন। সভা করবেন। এক বার নয়, বার বার। লোকসভা নির্বাচনের মহরত-পর্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে এটা অবশ্যই বিজেপির সুচিন্তিত ‘রাজনৈতিক’ কর্মসূচি।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে বইছে অজানা আশঙ্কার চোরা স্রোত। সুস্থ রাজনীতি যেখানে গৌণ হয়ে পড়ে। আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলার অবনতির। ভয় রাজ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ ক্ষুণ্ণ হওয়ার। বস্তুত যে ভাবে এই রথযাত্রার কর্মসূচি সাজানো হয়েছে তার খুঁটিনাটি দেখলে এই ধরনের আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক, তা হয়তো বলা যায় না। কোচবিহার তো ইতিমধ্যেই যথেষ্ট উত্তপ্ত। বিজেপির রাজ্য সভাপতির গাড়িতে হামলার ঘটনা অবশ্যই নিন্দনীয়। আবার রথের পথ বন্ধ করতে পুলিশ-প্রশাসনের তৎপরতার মধ্যেও উদ্বেগের লক্ষণ স্পষ্ট। ফলে এটিকে আর নিছক রাজনৈতিক কর্মসূচি বলা যাচ্ছে না।

Advertisement

রথ সংস্কৃতি, আমরা জানি, মূলত উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ধারা। আর তার প্রধান হোতা বিজেপি এবং তার সমমনোভাবাপন্ন কিছু হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। এর সহজ কারণ, হিন্দুদের শাস্ত্র-পুরাণে রথ বিষয়টি দেব-দেবী এবং অবতারদের বিবিধ লীলার সঙ্গে যুক্ত। রথ দিয়ে ‘পথ’ তৈরির ফর্মুলাটাও তাই খেটে যায়! দেখার বিষয়, বিগত কয়েক বছরে সেই সব রথের রশি তারা দেশের অন্যত্রও ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। ফলে রথযাত্রা ইদানীং একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মসূচি। এখানে ওখানে কথায় কথায় এখন রথ বেরোয়।

পাশাপাশি বিরোধীদেরও ওই সব কর্মসূচির সঙ্গে পরোক্ষে জড়িয়ে নিতে পেরেছে তারা। তাই এক রথের পাল্টা আবার অন্য রথ বেরোয়, এক অভিযানের পাল্টা অন্য অভিযান হয়।

এ কথা বলতেই হবে, হিন্দুত্ববাদীদের রথের আবহে কাজ করে এক ধরনের উগ্রতা। সহজ কথায়, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা। ফলে তার পাল্টা হিসাবে যা হয়, তাতেও কোথাও মিশে থাকে তারই ছোঁয়াচ। ১৯৯২-র ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে বিজেপির যে রথ বেরিয়েছিল, সেখান থেকেও সারা দেশে তেমনই বিষের বাষ্প ছড়ানোর কৌশল স্পষ্ট হয়েছিল। যার মর্মান্তিক পরিণতি হয় বাবরি-কাণ্ডে। সে দিন থেকে দেশ জুড়ে যে আগুন জ্বলল, এখন তা আরও বাড়ছে। বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ফিরে তাকানো যাক আমাদের রাজ্যে। ছেচল্লিশের দাঙ্গার পরে এই বঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার ক্লেদ বাসা বাঁধতে পারেনি। দেশের অনেক রাজ্যে যখন ধর্মের জিগির তোলা বিদ্বেষের আগুনে মানবিকতা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে, আমরা এই রাজ্যের গর্বিত বাসিন্দারা তখন বুক ফুলিয়ে বলতে পেরেছি, ও সব আমাদের জন্য নয়। দীর্ঘ সময়কালে প্ররোচনা যে ছিল না, বা থাকে না তা তো নয়। কিন্তু সে সব অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে আমাদের তৎপরতা থাকে তার চেয়ে অনেক বেশি। এখানকার অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এবং রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সবাই এই একটি জায়গায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে চায়।

তবে আশঙ্কার বিষয়, সময় দ্রুত পাল্টাচ্ছে। এই রাজ্যেও সব কিছু আর আগের মতো নেই। এক প্রবীণ কবির পঙ্‌ক্তি ধার করে বলা যায়, ‘‘কিন্তু এখন কানে অন্যরকম ভুজুং দিচ্ছে অন্যরকম হাওয়া!’’ তাই আমাদের দেখতে হয়েছে ধূলাগড়, বাদুড়িয়া, আসানসোলের মতো অবাঞ্ছিত কয়েকটি ঘটনা। বলতে দ্বিধা নেই, এই রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে এই ধরনের ঘটনার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার যথেষ্ট যুক্তি আছে। আসলে ক্রিয়া থাকলে প্রতিক্রিয়া থাকবেই। তা সকলের পক্ষেই প্রযোজ্য। রাজ্যে বিজেপির উত্থান তাতে ইন্ধন দিচ্ছে।

আসলে বিজেপি তো এটাই চায়। ইতিমধ্যেই রাম নবমী, হনুমান জয়ন্তী ইত্যাদি পালনের হিড়িক তুলে তৃণমূলকে পাল্টা পথে নামানোর কাজটি তারা সেরে ফেলেছে। তাতে বেশ কিছু জায়গায় উত্তেজনার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ সব আগে কখনও ছিল না। প্রশ্ন জাগে, এই সুবাদে রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে সাম্প্রদায়িকতার ভূত কি ক্রমশ তার ভবিষ্যৎ পাকা করে ফেলতে চলেছে? বিজেপির প্রস্তাবিত রথযাত্রা ঘিরেও এমন ভাবনাই এখন সবচেয়ে বড়।

কর্মসূচির পোশাকি নাম ‘গণতন্ত্র বাঁচাও যাত্রা।’ বিজেপির মতো একটি জাতীয় দল এই রকম একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতেই পারে। আপাত ভাবে এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ‘গণতন্ত্র বাঁচাতে’ উদ্যোগী দলটির রাজ্য সভাপতি নিজেই যখন ‘ধরব, মারব, কাটব, রক্ত বইবে’ মার্কা বিবিধ হুমকি দিয়ে রথের পথকে আগাম কর্দমাক্ত করেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, তাঁদের লক্ষ্য গণতন্ত্র ‘রক্ষা’, না কি অরাজকতার প্রতিষ্ঠা! বস্তুত সর্বনাশের ‘আশায়’ বসে থাকা অনেকের বড় পছন্দের! বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের আস্ফালন প্ররোচনার বারুদে ঠাসা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেই বারুদের স্তূপে আগুন লাগলে তিনি বোধ হয় নেহাত অখুশি হবেন না!

রথ-অভিযান চলাকালীন উত্তরপ্রদেশ থেকে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে এনে এখানে সভা করানোর পরিকল্পনার পিছনেও দলের কৌশল স্পষ্ট। কে না জানে, তাঁর অন্য যত গুণই থাক, উগ্র সাম্প্রদায়িকতার আড়ালে তা সবই ঢাকা পড়ে যায়। অসমে নাগরিকপঞ্জি থেকে লক্ষ লক্ষ বঙ্গভাষীর নাম বাদ যাওয়ার জন্য অভিযোগের আঙুল যাঁর দিকে, সেই সর্বানন্দকে আনার সিদ্ধান্তও অর্থবহ। এ সবের পিছনে উস্কানির উপাদান আছে কি না, সেই বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়ার নয়।

আবার ‘যাব না-যাব না’ করে গণ্ডি পেরোতে তৃণমূলও যেন মুখিয়ে আছে। যে পথে বিজেপির রথ যাবে, পর দিন সেই পথে ‘পবিত্র যাত্রা’ করার সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক চমক যতই থাক, আসলে যা হবে তা হল, তৃণমূলকেও পাল্টা পথে নামিয়ে দেওয়া। এতে এক দিকে বিজেপির কর্মসূচি গুরুত্ব ও মান্যতা পেয়ে যাবে, অপর দিকে প্রতিপক্ষকে রাস্তায় বার করার ঝুঁকিও থাকবে। বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল তো কয়েক হাজার খোল-করতাল নিয়ে তৈরি হয়েই রয়েছেন। বিজেপির রথের আগে আগে তাঁরা সঙ্কীর্তন করতে করতে যাবেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘যেমন শবযাত্রার সামনে নামগান হয়।’’ পরিস্থিতি এক বার কল্পনা করুন!

পরিশেষে এটিও মনে রাখা ভাল, বিজেপির এই কর্মসূচির সঙ্গে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-সহ সঙ্ঘের প্রায় সকল সংগঠনই কোনও না কোনও ভাবে জড়িত। যেমন, রথ চলাকালীন ডিসেম্বর জুড়ে রাজ্যে অন্তত পনেরোটি ধর্মসভা করতে চায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। এটিই তাদের ‘সুসময়’।

এখনও পর্যন্ত সবটাই পাকা ছকে বাঁধা। এক দিকে রাজনীতির পতাকা তলে গণতন্ত্র ‘বাঁচানো’র রথযাত্রা, অন্য দিকে একই সময়ে সঙ্ঘ পরিবারদের ‘ধর্মীয়’ কর্মসূচি। কে কার অলঙ্কার! শুভবুদ্ধিই এখন একমাত্র ভরসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন