অশেষ, অপরিসীম গরিমার একটা দিন পেরিয়ে এলাম। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্ব জুড়ে পালিত হল আরও এক বার সাড়ম্বরে। আরও এক বার আপামর বাঙালির হৃদয় সদর্পে বলে উঠল, মাতৃভাষার এ ভুবনজোড়া উদযাপনের সৌজন্যে আমরাই। কিন্তু ভাষার জন্য যে অবিশ্বাস্য এবং বিরল আত্মত্যাগ বাঙালি করেছে, বাংলা ভাষার অগ্রগতি কি আদৌ তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পেরেছে? বাংলা ভাষা কি তার কাঙ্ক্ষিত এবং প্রাপ্য প্রসারে পৌঁছতে পেরেছে? ভাষা দিবসের সুমহান উদযাপন পেরিয়ে এসে আজ এই প্রশ্নের সামনেই দাঁড়ানো উচিত বাঙালির।
বাংলাকে আমরা কিন্তু শুধু অন্দরমহলের ভাষা করেই রাখলাম এ যাবৎ। কর্মজগতের ভাষা বা গুরুতর চর্চার ভাষা হিসেবে বাংলাকে বেছে নেওয়ার চেষ্টাই করলাম না সে ভাবে। একটু ঘরোয়া কথকতা, একটু রোয়াকি আড্ডা, একটু ভালবাসা, একটু বিতণ্ডা, একটু খুনসুটি, একটু রং-তামাশা— এর বাইরে সে ভাবে কোনও ভূমিকাই নিতে দিলাম না বাংলা ভাষাকে। বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে, গল্পে-গানে-বিনোদনেও বাংলাকে আমরা রেখেছি ঠিকই। কিন্তু এইটুকু ব্যবহারিক পরিসর ভাষার কাঙ্ক্ষিত বিকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। সে বিকাশের জন্য জীবনের গূঢ়তর এবং গুরুতর ক্ষেত্রগুলিতেও বাংলার ব্যবহার সুনিশ্চিত করা জরুরি ছিল। সে চেষ্টা আমরা করলাম না। বাংলাকে আমার খিড়কি-পুকুর বানিয়ে রাখলাম, যেখানে শুধু বাসন মাজি। বাংলাকে সেই মহাসমুদ্র হয়ে উঠতে দিলাম না, যে জলভাগে বাণিজ্যতরী ভাসিয়ে আমি বিশ্বজয় করতে পারি। বাণিজ্যের জন্য আমরা বেছে নিলাম ধার করা জলভাগকে।
ভাষা ক্রমবিবর্তনশীল, ভাষা ক্রমবিকাশশীল। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, কোনও ভাষাই আজ পর্যন্ত সর্বাঙ্গীন পূর্ণতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি। আদান-প্রদানের ঘাত-প্রতিঘাতেই ভাষার বিকাশ হয়, ভাষার শব্দকোষ বাড়ে, ভাষা বলিষ্ঠ হয়, ভাষা প্রসার পায়। কিন্তু বাংলাকে অন্দরমহলে কুক্ষিগত করে রেখে সেই ঘাত-প্রতিঘাতটা থেকেই বঞ্চিত করলাম আমরা।
আত্মসমীক্ষার সময় এসেছে আজ। ত্রুটিটা এখনও সংশোধন করে নিতেই পারি। এই মুহূর্ত থেকে নতুন একটা লড়াইয়ে নামতেই পারি। সে ক্ষেত্রে সামনে শুধুই প্রসারণ। আর যদি এখনও গতানুগতিকতায় আবদ্ধ থাকি, তা হলে সঙ্কোচনই আমাদের ভাষার ভবিতব্য।