এখনও কেন সমাজের বহু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এই পণপ্রথা মেনে নিয়ে থাকেন?
সুসজ্জিত পণের নৌকায় চাপিয়ে বাবা-মা তাঁদের মেয়েকে ঘর থেকে বিদায় করেন। বলা ভাল, বৈতরণিতে ভাসিয়ে দেন। তবে তাঁরা হয়তো জানেন না ভারতের পণপ্রথা রদ আইন অনুযায়ী, পণ দেওয়া এবং নেওয়া দুই সমান অপরাধ।
দু’হাজার সাত সালে মহামান্য দিল্লি হাইকোর্ট একটি মামলার রায়ে পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি জারি করা এক নির্দেশিকায় বলেছে, যে শিক্ষিত বাবা-মায়েরা পণ নেওয়ার অভিযোগ করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে একই সঙ্গে পণ দেওয়ার অপরাধের জন্য মামলা দায়ের করতে হবে। যদিও, ভারতের পণপ্রথা রদ আইনে, যাঁরা পণপ্রথার শিকার হচ্ছেন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা না দায়ের করার বিধান আছে। দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় সেই সমস্ত শিক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধে, যাঁরা সব জেনেবুঝেও বরপক্ষের পণের দাবি মেনে নিয়ে থাকেন।
কিন্তু এখনও কেন সমাজের বহু তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ এই পণপ্রথা মেনে নিয়ে থাকেন? এর উত্তর খুঁজতে গেলে জটিল আইনি বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে ভারতীয় হিন্দু সমাজে পণপ্রথা ব্যাধির গভীরে বিচরণ করার প্রয়োজন। তবেই এই ঘৃণ্য ব্যাধির কারণ নির্ণয় করে তাকে নির্মূল করার চেষ্টা করা যাবে।
মহাভারতের কাহিনি থেকে জানা যায়, কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুন, কৃষ্ণেরই আপন বোন সুভদ্রাকে জোর করে তুলে এনে বিয়ে করেছিলেন। অর্জুনের এই আচরণে যখন সুভদ্রার বাকি আত্মীয়েরা ক্রুদ্ধ, তখন তাদেরকে শান্ত করতে কৃষ্ণ যুক্তিস্বরূপ জানিয়েছিলেন যে, প্রচলিত প্রথা মেনে অর্থের বিনিময়ে পাণিগ্রহণ করার ক্ষমতা অর্জুনের নেই। মহাভারতে আরও উল্লেখ আছে, মদ্ররাজ শল্য বহু মূল্যবান সামগ্রীর বিনিময়েই মাদ্রীর বিয়ে দিয়েছিলেন পাণ্ডুর সঙ্গে। যযাতির মেয়ে মাধবীকে পাওয়ার জন্য গালবকে অশ্বপণ দিতে হয়েছিল। অর্থাৎ, মহাভারতের সময়ে কন্যাপণ প্রথার প্রচলন ছিল, বিয়ে করার সময়ে বরপক্ষকেই পণ দিতে হত কনেপক্ষের কাছে। এই কন্যাপণ প্রথার উদ্ভবের কারণ জানতে ভারতীয় কৃষ্টির মূলে যাওয়া প্রয়োজন।
আর্যেরা ভারতে বৈদিক সংস্কৃতির প্রবর্তক। তাদের বহু আগে থেকেই নানা জাতির লোক এসেছে ভারত ভূমিতে। যেমন, অস্ট্রালয়েড বা প্রাক-দ্রাবিড় এবং দ্রাবিড়। এই অস্ট্রালয়েডরাই ভারতের আদিবাসী। এই আদিবাসীরা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়। শুরুতে আদিবাসী সমাজে একই গোষ্ঠীর মানুষদের ভাই-বোন বলে ভাবা হত এবং একই গোষ্ঠীর নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ের প্রচলন ছিল না। সেই কারণেই বহির্বিবাহ প্রথার উদ্ভব। বহির্বিবাহের প্রারম্ভিক সময়ে, হবু বর, বন্ধুদের নিয়ে অন্য কোনও গোষ্ঠীর এলাকায় গিয়ে কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করে নিয়ে আসত। তার পর নির্দিষ্ট সামাজিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহকে বৈধ করে নেওয়া হত। কন্যাকে এ ভাবে জোর করে কেড়ে আনার ফলস্বরূপ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল এবং সেই দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে স্থায়ী দ্বন্দ্বের রূপ নিয়েছিল। সমাজপতিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। উদ্ভব হল সামাজিক ভাবে উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে কন্যা বিনিময় প্রথা। স্ত্রীলোক জনন শক্তির ধারক। এ ছাড়া, আদিবাসী সমাজে মেয়েরা ঘরে-বাইরে শ্রম দানেও অভ্যস্ত। কাজেই অর্থনৈতিক বিচারেও মেয়েরা গোষ্ঠীর সম্পদ হিসেবে গণ্য হত । দুই গোষ্ঠীর এই সম্পদ তথা বংশবিস্তারের সুষ্ঠু ভারসাম্য রক্ষাই এই কন্যা বিনিময় প্রথার উদ্দেশ্য।
যেখানে যেখানে কন্যা বিনিময় প্রথা মেনে চলা সম্ভব হত না, সেখানে মানা হত শ্রমদান প্রথা। এই প্রথায় বরকে, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কনের বাড়িতে থেকে তাদের কৃষিকাজ বা পশুপালনে শ্রমদান করতে হত। শ্রমের মাধ্যমে কন্যাপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দেওয়াই ছিল শ্রমদান প্রথার একমাত্র উদ্দেশ্য।
কন্যাপক্ষকে ক্ষতিপূরণ দানের এই রীতি অক্ষত রেখে তার রকমফের ঘটালেন পরবর্তী সমাজপতিরা, ক্ষতির সমপরিমাণ মূল্য ধরে দেওয়ার প্রচলন করলেন। প্রাচীন কালে এই মূল্য বিনিময়ের মাধ্যম ছিলো গাভী অথবা প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী। পণ্যের পরিবর্তে কন্যা— কন্যাপণ প্রথার উদ্ভব হল।
বৈদিক যুগে আর্যেরা ভারতের আদিবাসীদের এই প্রথাকে অনুসরণ করে কন্যাপণ আদানপ্রদান করতেন। এই সময়ে ঘোড়া ছিল কন্যাপণের প্রধান বস্তু। কিছু আদিবাসী সমাজে আজও কন্যাপণ প্রথার প্রচলন আছে।
বৈদিক যুগে বিয়ের অনুষ্ঠানে, মেয়েকে তার নিজের বাড়ি থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য তো উপহার দেওয়া হতই, সঙ্গে কিছু মূল্যবান সম্পত্তিও দেওয়া হত যার উপরে অধিকার থাকতো শুধু মেয়েটিরই। তার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির নয়। মেয়েকে এই উপহার দেওয়ার প্রথাটিই ‘কন্যাদান’, অর্থাৎ কন্যাকে করা দান বা উপহার। এই প্রথাটি ভারতীয় হিন্দু সমাজে আজও প্রচলিত। কিন্তু জনমানসে হয়তো কন্যাদান শব্দের অর্থই পাল্টে গিয়েছে এখন। কন্যাদানের সময় মেয়ের পাওয়া যাবতীয় উপহার এবং ধনসম্পত্তি, যার উপর অধিকার শুধু মেয়েটিরই, এটাই স্ত্রীধন নামে পরিচিত। এই স্ত্রীধন, অর্থাৎ মেয়ের নিজের কিছু সম্পত্তির অধিকার, বিপদের সময়ে মেয়েটির অর্থনৈতিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করত।
প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে বরপণের বিশেষ কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মেগাস্থিনিসের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়, ভারতীয় বিবাহে পাত্রের কোনওরকম পণের চাহিদা ছিল না। সামাজিক বরপণের উদ্ভব তুলনায় অনেক পরে ঘটেছে। যখন ব্রিটিশ বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়নি, সেই সময় ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজারা প্রজাদের থেকে উদ্বৃত্ত ফসল কর হিসেবে নিতেন। যে মরসুমে ফসল উদ্বৃত্ত হত না, সেই মরসুমে কর মকুব করা হত। এই কর সংগ্রহের দায়িত্বে থাকতেন বিভিন্ন আঞ্চলিক তহসিলদারেরা। ব্রিটিশেরা ক্ষমতায় আসার পর নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে, এই ব্যবস্থাকে পাল্টে ফেলে পার্মানেন্ট সেটলমেন্ট অ্যাক্ট, ১৭৯৩ লাগু করল।
লেখক কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী