আমাদের অসহিষ্ণুতার প্রতি অসহিষ্ণু হতে হবে

সহিষ্ণুতা মানে ঠিক কী

সহিষ্ণুতা যে ভারতের সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য, সে কথাটা বহু লোক, বহু বার বলেছেন। কিন্তু সহিষ্ণুতা বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা স্পষ্ট হয়নি।

Advertisement

অরিন্দম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৭
Share:

‘ধর্ম’: বাবরি মসজিদ ধ্বংসের চব্বিশ বছর পূর্তিতে বজরং দলের ‘শৌর্য দিবস’, ধানবাদ

আজ থেকে হাজার বছর আগে কাশ্মীরে জন্মেছিলেন শৈব তন্ত্রাচার্য, নাট্যশাস্ত্রের টীকাকার অভিনবগুপ্ত। নিজের গীতাভাষ্যে তিনি খুব কড়া সমালোচনা করেছেন পরের ধর্ম ও উপাসনাবিধিকে যারা নিন্দে করে, সেই সব ‘আমার রাস্তাই ঠিক আর সব ভুল’-পন্থী বিদ্বেষকলুষিতহৃদয় গীতাব্যাখ্যাকারদের। তেমনই, হাজার বছর আগে ভারতে এসেছিলেন ইসলামীয় গণিত ও দর্শনের দিকপাল পণ্ডিত আল্ বিরুনি। শুধু তাঁর ভারতভ্রমণ ও ভারতের ধর্ম, দর্শন, কৃষ্টিকে বোঝার প্রয়াসের বিবরণই যে তিনি লিখে গিয়েছেন, তা নয়। সংস্কৃত শিখে তিনি পাতঞ্জল যোগসূত্রের আরবি ভাষায় অনুবাদ ও টীকারচনা করে গিয়েছেন, যার নাম ‘কিতাব পতঞ্জল।’ প্রাত্যহিক জীবনে এক জন ছিলেন নিষ্ঠাবান শৈব, অন্য জন নিষ্ঠাবান মুসলমান। দু’জনের কেউই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ছিলেন না কোনও অর্থেই। কিন্তু দু’জনেই ছিলেন অসহিষ্ণুতার প্রতি অসহিষ্ণু।

Advertisement

সহিষ্ণুতা যে ভারতের সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্য, সে কথাটা বহু লোক, বহু বার বলেছেন। কিন্তু সহিষ্ণুতা বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা স্পষ্ট হয়নি। বরং নিজের ধর্মবিশ্বাসের জন্য খানিকটা সংকুচিত, ইদ-ক্রিসমাস-জন্মাষ্টমী-বুদ্ধপূর্ণিমা সবেতেই ছুটি নিয়ে ধর্মে একটু নড়বড়ে হওয়াকে বুঝিয়ে এসেছে। আমার মনে হয়, সহিষ্ণুতাকে দেখা উচিত ‘ডাবল নেগেশন’ দিয়ে। ভারতীয় সংস্কৃতি হল অসহিষ্ণুতার প্রতি অসহিষ্ণু। প্রত্যেক ভারতবাসীর শিকড় রয়েছে দেশের কোনও না কোনও বিশিষ্ট ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জীবনযাপনের ধারায়। কিন্তু সে যে কেবল অপরকে সহ্য করে তা নয়। সে ভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্মকে শ্রদ্ধা করে, তার থেকে শেখে। শ্রীরামকৃষ্ণের যে ভক্ত, সে গির্জা বা মসজিদের সামনে মাথা নোয়ায়, কিন্তু তার জন্য তাকে কালীপুজো ছাড়তে হবে এমন কথা স্বপ্নেও ভাবে না। উত্তর ভারতের মানুষ কখনও কখনও দক্ষিণ ভারতের খাবার খান, বাঙালি মেয়ে অসমিয়া লোকসংগীত শেখে। এর কোনওটার জন্য সরকারি প্রকল্পের অপেক্ষায় থাকতে হয় না, স্বাভাবিক নিয়মেই এমন হয়।

অসহিষ্ণুতা যে ভারতীয়ত্বের বিরোধী, এই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে জৈনদের তর্কশাস্ত্র, শ্রীরামকৃষ্ণের শিক্ষা আর বিশ শতকের সব থেকে স্বকীয় চিন্তার পথিকৃৎ দার্শনিক কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্যের থেকে। যা ভাল, তা সবার জন্য ভাল, এই ধারণাটাই ভারতে উদ্ভূত কোনও ধর্মে মিলবে না। সকলেই এক দেবতাকে পূজার অধিকারী, একই ধরনের শিক্ষা বা সংস্কৃতি সবার জন্য বরাদ্দ, ভারতীয় ধর্ম এমন ভাবে না। ‘অমুক রীতিনীতি, বা খাবার, বা ধর্মাচরণ কি ভাল?’ এমন প্রশ্ন করা চলে না। ‘অমুক ধরনের লোকের জন্য কোন উৎসব, কোন সংস্কার ভাল?’ এই হল ঠিক প্রশ্ন। এই জন্যই আমরা মনে করি, স্বধর্ম আঁকড়ে মরে যাওয়াও ভাল, পরধর্ম গ্রহণ করা চলে না। এটা গোঁড়ামি, বা অপরের প্রতি বিদ্বেষ-তাচ্ছিল্যের জন্য নয়। পাশ্চাত্যে বরং মনে করা হয়, একটি ধর্ম গ্রহণ করা মানে অপর কোনও উপায়ে জীবনের সার্থকতা পাওয়ার সম্ভাবনাকে খারিজ করে দেওয়া। সম্প্রতি এমন একটা একবগ্‌গা মনোভাব ভারতের কিছু কিছু ধর্মেও দেখা দিচ্ছে বটে। কিন্তু আজও যাঁরা ধর্মনিষ্ঠ ভারতীয়, তাঁরা সাধারণত অন্যান্য ধর্ম বা মতবাদকে দেখেন ঈশ্বরপ্রাপ্তির বিকল্প নানা পথ বলে। ভ্রান্ত পথ, মিথ্যা দেবতা, এ সব ধারণা ভারতে নেই। সোজাসাপটা ‘ভজ গৌরাঙ্গ’ গান যেমন বৈষ্ণব কীর্তন, তেমনই বিলম্বিত, জটিল দশকুশী তালের মাথুর কীর্তনও বৈষ্ণব কীর্তন। বাউল ও বৈদান্তিক, দু’জনেই গুরু গোবিন্দের ভক্ত জ্ঞানী হতে পারেন।

Advertisement

কিন্তু সহিষ্ণুতার চেহারাটা আমাদের আটপৌরে জীবনে ঠিক কেমন হবে, সহিষ্ণু হওয়া মানে ঠিক কেমন হওয়া, সেটা স্পষ্ট নয়। এর একটা মানে হল, ‘যার জন্য যেমন, তার জন্য তেমন।’ পরিবারের পাঁচটা লোক পাঁচটা আলাদা ধর্ম মেনে চলতে পারে, এমনকী এক জনই নানা ধর্মের একটা ইচ্ছেমত সংমিশ্রণ মানতে পারে। আমার ভাইপো নিষ্ঠাভরে সরস্বতী পুজো করত, কিন্তু পরীক্ষার দিন নুসরত ফতে আলি খানের ছবিতে প্রণাম করে যেত। অনেক পরিবারে বাবা-মা নিষ্ঠাবান হিন্দু, মেয়ে কনভেন্ট স্কুলে যায়, গলার চেনে ক্রস ঝোলায়, ক্রিসমাসের আগের সন্ধ্যায় গির্জায় গিয়ে প্রার্থনায় অংশ নেয়। ধর্ম হল প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ব্যাপার, উত্তর-শিল্পায়ন যুগের এই ধারণা শহুরে উচ্চ শিক্ষিতদের একাংশের মধ্যে প্রচলিত। এ এক ধরনের চরম আপেক্ষিকতাবাদ (একস্ট্রিম রিলেটিভিজম)। যার মুশকিল হল, সব ধর্মই কোনও এক সত্যকে নির্দেশ করে, এবং সেই সঙ্গে তার অনুসারী ন্যায়বোধকে। ধর্মকে (পোশাক বা সংগীতের মতো) ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের বিষয় করে ফেললে বলতে হয়, সত্য ব্যক্তিনির্ভর, ভাল-মন্দের বিচারও তাই। এমন ধারণার উপর সমাজকে দাঁড় করানো মুশকিল।

অনেকে অবশ্য ধর্মের সঙ্গে সত্যের যোগই স্বীকার করতে চান না। সত্যের নামে অতীতে অতিশয় বুজরুকি, নির্যাতন, যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, তাই ধর্মলব্ধ সত্য থাকতে পারে, এই সম্ভাবনাকেই উড়িয়ে দিতে চান তাঁরা। এ-ও এক ধরনের ফ্যাসিজ্ম। এঁদের একাংশের মত, সহিষ্ণুতা মানে বিজ্ঞানমনস্কতা। ভারতের বিবিধ সংস্কৃতির মহান মিলনক্ষেত্র বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, যার গায়ে কোনও ধর্মের ছাপ নেই। মুশকিল হল, বিজ্ঞানের গায়ে কী করে ‘ভারতীয়’ বা অন্য কোনও জাতির ছাপ মারা যায়, তা-ও স্পষ্ট নয়। টেলিভিশনের চ্যানেলে প্রবচন শোনা, জিরে-হলুদ দিয়ে প্রেশার কুকারে রান্না, হোয়াটসঅ্যাপে বলিউডের পুরনো গান পাঠানো, আমাদের মধ্যে আর কোনও মিল যদি না থাকে, তবে ‘ভারতীয়’ কথাটাই অর্থহীন হয়ে যায়।

এই মিল খোঁজার একটা চেষ্টা এক সময়ে করেছিলেন ব্রাহ্মরা। খ্রিস্টানদের এক ধরনের মত (ইউনিটেরিয়ানিজম) অনুসরণ করে তাঁরা মনে করতেন, সত্য সকলের প্রতি সমান, তাই নানা সংখ্যার গসাগু করার মতো বিভিন্ন ধর্মের থেকে ‘যথার্থ’ শিক্ষাগুলি চয়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মুশকিল হল, এই নির্বাচনের মধ্যেও নির্বাচকের ট্র্যাডিশন ঢুকে থাকে। যে কীর্তন শুনতে অভ্যস্ত, সে সাম্বা, শ্রেয়া ঘোষালের গান আর বব ডিলানের সংগীত থেকে ‘কমন ফ্যাক্টর’ খুঁজতে গিয়ে হয়তো শ্রীখোলের বোল খুঁজে পাবে। কারণ সেটা তার মধ্যে আগে থেকে ঢুকে রয়েছে।

এগুলি যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তা হলে সহিষ্ণুতার উপাদান কোথা থেকে পাব? আমি আমার অবস্থান পাচ্ছি দু’জনের কাছ থেকে। এক জন সম্রাট অশোক। অন্য জন কাশ্মীরের শৈব পণ্ডিত, অভিনবগুপ্ত।

অভিনবগুপ্ত বলেছেন আমি শৈব, বৌদ্ধ নই। কিন্তু বৌদ্ধদের সঙ্গে তর্ক না করলে আমাদের শৈব-শাক্ত শাস্ত্র তৈরি হত না। পূর্বপক্ষের (বা প্রতিপক্ষের) ঘর থেকে আমাদের অনেক কিছু গ্রহণ করার রয়েছে। মনে রাখতে হবে, বৌদ্ধরা আত্মা বা ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তাঁদের থেকে জ্ঞান আহরণ করছেন শৈব অভিনবগুপ্ত। কেবল সহ্য করা নয়, তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, তার বিষয়ে কৌতূহল, ভারতে সহিষ্ণুতার এই হল লক্ষণ। তর্ক করতে হিন্দু সর্বদাই উৎসাহী। দুটি বিরোধী মতের মধ্যে তর্ক হবে, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। পঞ্চাশ বছর আগেও বিহারে শ্রাদ্ধে বিরোধী মতের পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে আনা হত। অতিথিরা পান চিবোতে চিবোতে দুই পক্ষের তর্ক শুনতেন। ‘ডিবেট’ ছিল নাচগানের মতোই উৎসবাঙ্গ।

এখন আচারনিষ্ঠ পণ্ডিত বা সাধুসন্ন্যাসীদের যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা ‘সব শেয়ালের এক রা’ গোছের গোঁড়া হিন্দুর ভাবমূর্তি। নিয়মনিষ্ঠা, আচারবিচারের বিষয়ে পূর্বপুরুষদের শিথিলতা ছিল না ঠিকই, আজকের দৃষ্টিতে তাঁদের বাহ্যিক আচরণকে ‘গোঁড়া’ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু মনের দিক থেকে তাঁদের অপর মতের সঙ্গে, ধর্মের সঙ্গে তর্কবিতর্কে, মতের আদানপ্রদানে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ ও অভ্যাস ছিল। তীক্ষ্ণ যুক্তিতে অপরের ধর্মমত-উদ্ভূত দর্শনকে খণ্ডন করে তার মধ্যে থেকে সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া, এই ছিল রীতি। আজ তাঁদেরই উত্তরপুরুষরা ‘আমার ধর্মীয় আবেগে আঘাত লেগেছে’ বলে কথায় কথায় মারমুখী হয়ে উঠছেন। এই অসহিষ্ণুতা সর্বতো ভাবে অ-ভারতীয়।

বরং আজকাল ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’ বলে হিন্দুত্ববাদীরা এমন আচার প্রচলন করছেন, যা হিন্দু শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। যেমন সামূহিক যোগ। যোগ যদি ধর্মাচরণ হয়, তা গোপনে করতে হবে, এ কথা বেদ, উপনিষদসহ বহু শাস্ত্রে বলা আছে। এখন রাজপথে দল বেঁধে যা করা হচ্ছে, হিন্দু ধর্মের দৃষ্টিতে তা ‘যোগ’ হতে পারে না। মহাভারত শান্তিপর্বে (১৯৩ অধ্যায়ে, আবার ২৪৪ অধ্যায়ে) বলা হচ্ছে, ‘এক এব চরেৎ ধর্মং, ন ধর্মধ্বজিকো ভবেৎ।’

(চলবে)

ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই’তে দর্শনের অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন