প্রবন্ধ ২

মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২ থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ, তাতেই কি মুশকিল আসান?

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার মহিলা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করেছে। এই ছুটি সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে ২৬ সপ্তাহের সবেতন এই ছুটি পৃথিবীতে খুবই কম দেশে চালু রয়েছে।

Advertisement

অরিজিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৭ ০৯:৩০
Share:

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার মহিলা কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ১২ সপ্তাহ থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করেছে। এই ছুটি সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রকৃতপক্ষে ২৬ সপ্তাহের সবেতন এই ছুটি পৃথিবীতে খুবই কম দেশে চালু রয়েছে।

Advertisement

চিকিৎসাবিজ্ঞানের তত্ত্ব বলে, জননী মাতৃকালীন ছুটিতে থাকলে শিশুমৃত্যু ও মায়ের মৃত্যুর হার কমে। শিশুরা দীর্ঘ সময় স্তন্যপানের সুবিধে পায়। মায়ের কাছে থাকার ফলে শারীরিক ও মানসিক বিকাশও অনেক বেশি হয়। এই জন্যই কর্মরত মায়েদের ২৬ সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে কাজে ফেরার সম্ভাবনাও অনেক বাড়ে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ভারতের উচ্চশিক্ষিত মায়েরা প্রথম সম্তানের জন্মের পর অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেন। এই প্রবণতা অনেকটাই হয়তো কমবে।

কিন্তু কয়েকটি কথা। এক, সাধারণত দরিদ্র দেশে মহিলারা কাজ করেন প্রধানত সংসারের দারিদ্র কমাতে বা আকস্মিক সংকট সামাল দিতে। পরিবারের স্ত্রী বা কন্যা বা পুত্রবধূ কোনও টাকা রোজগার করবেন কি না তা নির্ভর করে মহিলার শিক্ষা, পরিবারের সামাজিক প্রতিষ্ঠা, স্বামীর আয় ইত্যাদির উপর। মাতৃকালীন ছুটি কোনও দেশের কর্মনিযুক্তি কতটা বাড়াতে পারবে, বলা শক্ত।

Advertisement

দুই, ভারতের সমতুল দেশগুলিতে যখন মহিলাদের কর্মনিযুক্তির হার প্রায় ৫০ শতাংশ, ভারতে তা ১৯৯৯-২০০০’র ৩৪ শতাংশ থেকে কমে ২০১১-১২’য় ২৭.২ শতাংশে ঠেকেছে। পুরুষদের নিযুক্তি এক-তৃতীয়াংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও মহিলাদের নিযুক্তি অনেক কমেছে। কর্মরতা মহিলাদের দুই-তৃতীয়াংশ আবার কাজ করেন অসংগঠিত কর্মীরূপে, আইনি চুক্তি ছাড়াই। অর্থাৎ, তাঁরা এই জাতীয় ছুটি বা সুবিধের বাইরে।

তিন, ২৬ সপ্তাহ সবেতন ছুটি দেওয়া হলে বেসরকারি বা আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নতুন কর্মী নিযুক্ত করতে হবে সংশ্লিষ্ট মহিলার জন্য ধার্য কাজগুলি করে দেওয়ার জন্য। মানে, মহিলার বেতন ছাড়াও সাড়ে চার মাস সংস্থাকে বইতে হবে অতিরিক্ত খরচ। অনেক ছোট বা মাঝারি সংস্থা এমন ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে প্রথমেই সমদক্ষতার নারী-পুরুষের মধ্যে পুরুষ কর্মীর নির্বাচন করবে। চার, যেহেতু সচরাচর পুরুষ ও মহিলা কর্মীর বেতন বৈষম্য চোখে পড়ার মতো, তাই একই পরিবারে সমান শিক্ষিত মহিলা ও পুরুষের মধ্যে পুরুষের কর্ম সংস্থানে নিযুক্তির সম্ভাবনা প্রবলতর থাকে।

এর মানে এই নয় যে মাতৃকালীন ছুটির প্রয়োজন নেই। তবে এই ছুটিকে মহিলাদের কর্ম নিযুক্তির পথে বিরাট পদক্ষেপ ভাবা ঠিক নয়। আরও কিছু বিষয় মনে রাখা জরুরি। প্রথমত, এই ছুটি মা বা বাবাকে যে কোনও অনুপাতে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। পিতৃকালীন ছুটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য হলেও, সকলে নিতে উৎসাহী থাকেন না। সামাজিক চাপে এ ছুটিকে নিচু চোখে দেখার প্রবণতা আছে। তাই সংযুক্ত পেরেন্টাল ছুটির ভার শেষ অবধি মাকেই বহন করতে হতে পারে। কিছু ইউরোপীয় দেশের নিয়ম হল, ১২ সপ্তাহ ছুটির প্রথম তিন সপ্তাহ মায়ের জন্য, দ্বিতীয় তিন সপ্তাহ বাবার জন্য, শেষের তিন সপ্তাহ যে কেউ নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, এই ছুটির জন্য সংস্থার অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে দিতে কর ছাড় দেওয়া যেতে পারে। এই অতিরিক্ত খরচ বেসরকারি সংস্থা, সরকার ও বিমা সংস্থার মধ্যে ভাগাভাগি করে দেওয়া যেতে পারে, একাধিক পূর্ব-ইউরোপীয় দেশে যা করা হয়।

আর, এমন ছুটি সংগঠিত ক্ষেত্রের মেয়েদের কাছে সুখবর হলেও, দরিদ্র, অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত মহিলাদের কাজে অংশগ্রহণের বিষয়ে খুব প্রাসঙ্গিক নয়। তাঁদের জন্য চাই আরও সুচিন্তিত পরিকল্পনা। যেমন, নারেগা’র মতো কর্মসংস্থান নীতির সঙ্গে মাতৃকালীন ছুটির সংযুক্তি (জব কার্ড যে সব মহিলাদের আছে, তাঁদের সবেতন ছুটি) বা স্বনির্ভর কর্মসংস্থানে তাঁদের বিশেষ সাহায্য প্রদানের কথা ভাবা যেতে পারে। অবশ্যই প্রথম দুই সন্তানের জন্য। এ ব্যাপারে তাই আরও আলোচনা দরকার।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন