পার্থবাবু বলিয়াছেন, কিচ্ছু হয় নাই। ভর্তি লইয়া কোনও কলেজে কোনও দুর্নীতি নাই, কেউ এক পয়সাও ঘুষ দাবি করে নাই। যত দোষ সাইবার ক্যাফেগুলির। সেখানে ফর্ম ভরিতে গোলমাল হওয়ার ফলেই কলেজে কলেজে ভর্তি লইয়া এই অশান্তি চলিতেছে। আশঙ্কা হইতেছে, পার্থবাবু দাবি না করিয়া বসেন যে, তিনি যে হেতু কলেজগুলিকে পয়সা দেন, ফলে তিনি যাহা বলিতেছেন, গোটা রাজ্যের মানুষকে তাহাই কলেজের বাস্তবচিত্র হিসাবে মানিয়া লইতে হইবে। এই যুক্তি ভিন্ন কলেজ-দুর্নীতি বিষয়ে তাঁহার কথাগুলি মানিয়া লওয়া দুষ্কর। কলেজে যদি ইউনিয়নের দাদা-দিদিরা ভর্তির জন্য টাকা দাবি না-ই করে, তবে কলিকাতা পুলিশকে কেন সোশ্যাল মিডিয়ায় বার্তা দিতে হয়? যদি সহজ পথে ভর্তির ব্যবস্থাই থাকে, তবে মুখ্যমন্ত্রীকে কেন আচমকা কলেজ পরিদর্শনে যাইতে হয়, কেনই বা মন্ত্রীদেরও পরিদর্শনে যাওয়ার পরামর্শ দিতে হয়? বস্তুত, স্বয়ং পার্থবাবুই বা কিসের খোঁজে কলেজসফরে গিয়াছিলেন? মন্ত্রিবর যে সত্যের প্রতি বিশেষ দায়বদ্ধ নহেন, তেমন জনরব প্রবল। কেহ বলিতে পারেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় হইতে বাস্তবকে অস্বীকার করিবার যে প্রবণতা তাঁহার মধ্যে প্রকট হইয়া উঠিয়াছিল, কলেজ-পর্বেও তাহারই রেশ চলিতেছে। বস্তুত, কেহ আরও আগাইয়া বলিতে পারেন, অস্বীকার করিবার প্রবণতাটি উপসর্গমাত্র— আসল রোগ অপরাধীদের আড়াল করিবার চেষ্টা। পশ্চিমবঙ্গ সেই রোগের মাসুল গনিতেছে। কলেজগুলিও।
রোগটি মারাত্মক। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যদি এখন অনুব্রত মণ্ডল আর তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে ফারাক না করিতে পারেন, তাহার দায় দলের নেতৃত্বের। যে সন্ত্রাসের নিন্দা করিয়া অপরাধীদের দল হইতে বিচ্যুত করাই কর্তব্য ছিল, পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা অপরাধীদের আড়াল করিবার তাগিদে সেই অপরাধটিকে দলের সিদ্ধান্ত হিসাবে স্বীকৃতি দিয়া বসিয়াছেন। কলেজে ভর্তি-দুর্নীতির ক্ষেত্রেও তিনি ঠিক একই ভুল করিতেছেন। বিভিন্ন কলেজে বেশ কয়েক হাজার বা লাখ টাকা দরে বিভিন্ন বিষয়ের আসন বিক্রয়ের যে ব্যবসা চলিতেছে, তাহাতে যুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় তিনি বিলক্ষণ জানিবেন। প্রয়োজন ছিল সেই পরিচয়টি ভুলিয়া তাহাদের অপরাধী হিসাবে দেখিবার। তাহার পরিবর্তে স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী যদি গোটা ঘটনাটিকেই অস্বীকার করিতে চাহেন, তবে বার্তাটি পড়িয়া লইতে সংশ্লিষ্ট দুষ্কৃতীদের অসুবিধা হইবে না। তাহারা জানিবে, মাথার উপর হাত আছে। মুখ্যমন্ত্রীও কি তাঁহার বিবৃতিতে আরও একটু কড়া হইতে পারিতেন না? বিষয়টি যে ‘ছোট ছেলেদের ছোট ভুল’ নহে, বরং একটি সংগঠিত অপরাধ, তাহা স্পষ্ট ভাষায় বলা মন্ত্রিবরের কর্তব্য ছিল।
ভর্তি-প্রক্রিয়াকে ঘিরিয়া যে দুর্নীতি চলিতেছে, শেষ বিচারে তাহার দায় কাহার? উত্তরে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দিকেই আঙুল উঠিবে। কারণ, তিনি শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষাব্যবস্থাটি যাহাতে বাধাহীন ভাবে, নির্বিঘ্নে চলিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করিবার দায়িত্ব তাঁহার উপরই বর্তায়। কলেজে কলেজে কিছু ছাত্রনেতা অথবা ‘বহিরাগত’ যাহাতে সমান্তরাল প্রশাসন চালাইতে না পারে, ইচ্ছামতো আসন বিক্রয় করিতে না পারে, তাহা দেখিবার কথা ছিল পার্থবাবুরই। এত দিনে স্পষ্ট, শিক্ষামন্ত্রী হিসাবে তিনি নিজের দায়িত্বটি বুঝিতেই পারেন নাই। তাঁহার কাজ যে প্রতিষ্ঠানগুলির স্বশাসনের অধিকার খর্ব করিয়া ছড়ি ঘুরানো নহে, বরং শিক্ষার সার্বিক পরিবেশটি বজায় রাখা, তিনি এত দিনেও জানেন নাই। আশঙ্কা হয়, ভবিষ্যতেও জানিবেন না। অতএব, এমন এক শিক্ষামন্ত্রীকে লইয়া রাজ্য কী করিবে? তাঁহার ব্যর্থতাগুলি যখন এতই স্পষ্ট, তখন অন্য শিক্ষামন্ত্রী বাছিয়া লওয়ার সময় আসিয়াছে বলিয়াই বুঝিতে হইবে।