উন্নয়নের ছাঁচে ঢালা প্রয়াস কেন ব্যর্থ হয়

গরিব যে ভাবে লড়েন

ধৈর্য, অধ্যবসায়, ‘সহজে বোর না হওয়া’র অধুনাবিরল গুণ না থাকলে এই জটিল প্রক্রিয়ার অনুপুঙ্খ বোঝা অসম্ভব। সেই শক্ত কাজটাই করেছেন ইংল্যান্ডের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ রায় (পলিটিক্স অব দ্য পুয়োর, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস)।

Advertisement

দিলীপ ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:০০
Share:

সমাজটাকে বিদ্বজ্জনরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে পরামর্শ দেন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠী সেগুলি নেড়েচেড়ে রাজনৈতিক সুবিধা অনুযায়ী আইন, নীতি, কর্মসূচি, প্রকল্প ইত্যাদি তৈরি করে। সারা দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াগুলির কাঠামো এক, তাই একই ছাঁচে গড়া হয় সে সব উদ্যোগ। প্রাথমিক সুফল মাপা হয় কর্মসূচির খরচের তথ্য দিয়ে, অনেক পরে কোনও নিরীক্ষায় দেখা যায় প্রয়াসটি নিষ্ফল, তখন আর একটা কর্মসূচি জন্মায়।

Advertisement

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি উন্নয়নের এই এক ছাঁচে ঢালা প্রয়াস সর্বত্র একই ভাবে সফল বা বিফল হয় না। এমন তত্ত্বেরও সন্ধান পাইনি, যা দিয়ে সব ব্যর্থতা বা সাফল্যের ব্যাখ্যা সম্ভব। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো, প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক দল, সব কিছুর সঙ্গেই গরিব মানুষ দর কষেন নানা ভাবে। সেই দর-কষাকষি প্রভাব ফেলে উন্নয়ন কর্মসূচির ওপর। শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, এ সবের মিথস্ক্রিয়ায় নানা চেহারা নেয় উন্নয়নের প্রয়াস। সেই সব সমীকরণ কখনও বিভ্রান্ত করত, কখনও হতাশ। সামগ্রিক ছবিটি অধরাই থেকে যেত আমাদের।

ধৈর্য, অধ্যবসায়, ‘সহজে বোর না হওয়া’র অধুনাবিরল গুণ না থাকলে এই জটিল প্রক্রিয়ার অনুপুঙ্খ বোঝা অসম্ভব। সেই শক্ত কাজটাই করেছেন ইংল্যান্ডের ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইন্দ্রজিৎ রায় (পলিটিক্স অব দ্য পুয়োর, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস)। জমি বেশি মানে সামাজিক প্রতিপত্তিও বেশি— এই অনুমানের ভিত্তিতে, প্রান্তিক পরিবারগুলির নিজস্ব জমির পরিমাণ ধরে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার রহিমপুর আর দিত্যা, বিহারের আরারিয়া জেলায় সরগনা ১ নম্বর ওয়ার্ড আর রোশনারা ৫ নম্বর ওয়ার্ড, এই চারটি গ্রাম বেছে ইন্দ্রজিৎ বিচার করেছেন সেখানকার নানা সামাজিক-রাজনৈতিক সমীকরণ। গবেষণার স্বার্থে সামাজিক শ্রেণিগুলিকে তিন ভাগ করেছেন তিনি— ১) সুরক্ষিত (এনট্রেঞ্চড): মূলত উচ্চবর্ণ, মজুর খাটানো, কৃষিভিত্তিক সমাজের চুড়োয় থাকা বিত্তশালী; ২) অরক্ষিত (প্রিকেরিয়াস): জাতিগত ভাবে নিচু কিন্তু ধনী বা মধ্যশ্রেণির চাষি, উচ্চবর্ণের দরিদ্র চাষি, দলিত ও আদিবাসী শ্রেণির ভূম্যধিকারী, কখনও মজুর খাটান, কখনও খাটেন, ব্যক্তিগত ভালমন্দ রাজনৈতিক দলের উত্থানপতনের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িত এবং ৩) মজুর: গতর ছাড়া যাঁদের কোনও সম্পদ নেই, দলিত ও আদিবাসীদের একটা বড় অংশ, যাঁরা অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যেরও শিকার।

Advertisement

৪২৪টি পরিবারের বাসস্থান রহিমপুরে ৮ শতাংশ হিন্দু। এখানে ‘শেখ’ গোষ্ঠীভুক্ত মুসলমান সুরক্ষিত শ্রেণির পরিবারগুলি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ও ‘শেরশাবাদিয়া’ মুসলমানদের সমগোত্রীয় ভাবেন না। অরক্ষিত শ্রেণিভুক্তরা বর্গাপাট্টা বিতরণে উপকৃত হলেও ভূমিহীন মজুর কিছু পাননি। সুরক্ষিত ও মজুরেরা এখানে অরক্ষিতদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ।

৩২৬টি পরিবারের দিত্যা গ্রামে দেশিয়া গোষ্ঠীভুক্তদের আধিপত্য, তাঁরাই মজুর খাটানো পরিবারদের মধ্যে সংখ্যাগুরু। সাঁওতালরাও আছেন, প্রধানত মজুর। দেশিয়া অরক্ষিত শ্রেণির মানুষ সুরক্ষিতদের সঙ্গেই একাত্ম বোধ করেন, সাঁওতালদের সমমর্যাদাসম্পন্ন ভাবেন না। পঞ্চায়েতে আসন আদিবাসী মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হলেও সুরক্ষিতদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকে।

১৬৫টি পরিবারের গ্রাম সরগনা ১ নম্বর ওয়ার্ডে সুরক্ষিত শ্রেণি রাজপুত আর কায়স্থরা। অরক্ষিত শ্রেণিতে এই দুই গোষ্ঠীর দরিদ্রতর কৃষকরা, যাদব, কেওট, দুসাদ, ধোবি ও মুশাহর মজুর খাটানো পরিবাররা আছেন। সব জাতিরই ভূমিহীন দরিদ্রতমরা মজুর শ্রেণিতে। সুরক্ষিতদের বিরুদ্ধে শ্রেণিগত সখ্য গড়েছেন অরক্ষিত আর মজুররা।

রোশনারা ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১৬০টি পরিবারের মধ্যে একটিমাত্র মজুর খাটানো পরিবার গঙ্গোট জাতির। মজুরদের বাকি ৮০ শতাংশ কুঁজরা মুসলমান শ্রেণির। এখানে সুরক্ষিত আর অরক্ষিতরা একজোট মজুরদের বিরুদ্ধে।

এই বৈচিত্রময় পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন উন্নয়নী উদ্যোগগুলির পরিণতি দেখিয়েছেন ইন্দ্রজিৎ। যে সব কর্মসূচির সংখ্যাগত সীমাবদ্ধতা থাকে, যেমন বিপিএল তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, দুর্বলতমরা সেগুলির দর কষেন আবেদন-নিবেদনের পথে। রহিমপুরে মজুরদের সেই প্রচেষ্টায় মদত দেন সুরক্ষিতরা, অরক্ষিতদের জব্দ করতে। দিত্যার জাতিগত বিন্যাসের ফলে দেশিয়া সুরক্ষিত ও অরক্ষিতরা একজোট হন সাঁওতাল মজুরদের আবেদন অগ্রাহ্য করতে। সরগনায় অরক্ষিত শ্রেণির মুখিয়া জাতি নির্বিশেষে মজুরদের বিপিএল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট। রোশনারার অরক্ষিত মুখিয়া স্বজাতিভুক্তদের বিপিএলে ঢোকান কারসাজি করে, কুঁজরা মুসলমান মজুরদের বাদ দেন স্বচ্ছন্দে।

লেনদেনের চেহারা বদলে যায় স্ব-নির্বাচনের সুযোগ থাকা এনরেগা কর্মসূচিতে। রহিমপুরে সুরক্ষিতরা এটি ব্যবহার করে মদত দেন মজুরদের। তাঁদের নিজের জমিতে উৎপাদনও সুকৌশলে অন্তর্ভুক্ত হয় কর্মসূচিতে। মজুরদের বর্ধিত মজুরির ভার চাপে অরক্ষিতদের ওপর। দিত্যা গ্রামে দেশিয়া ও সাঁওতাল মজুররা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই কাজের দাবি করেন, সংখ্যার সীমা নেই তাই প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই। সরগনাতেও শ্রমিকরা সঙ্ঘবদ্ধ। রোশনারায় সুরক্ষিত ও অরক্ষিত একজোট হয়ে মজুরদের এই কর্মসূচি থেকে বঞ্চিত রাখেন। রোজগার নিশ্চিতির মাধ্যমে মজুর রাষ্ট্রের কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠছেন, এক ধরনের শ্রেণিসংহতিও গড়ে উঠছে। কিন্তু ভোট যে অর্থে ‘অধিকার’, ‘রোজগার’ এখনও সেই অর্থে অধিকার হয়ে ওঠেনি— কাজের দাবি আদায়ের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের উপরই নির্ভরশীল গরিবরা।

রহিমপুরের বিদ্যুদয়ন প্রকল্প অন্য সমীকরণ গড়ে। বিদ্যুৎবাহী খুঁটি কোথায় বসবে, তা নিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনায় বসেন প্রধান। বিদ্যুৎ ‘পাবলিক গুড’, কিন্তু গ্রামের স্বার্থে ত্যাগের দায় যেন ‘ক্ষমতার’ সঙ্গে সমানুপাতিক হয়, কেবল দরিদ্রদের ঘাড়ে না পড়ে। এই গণতান্ত্রিক লেনদেনে আর্থ-সামাজিক ভাবে নতজানু শেরশাবাদিয়াদের কণ্ঠস্বরেও ভিন্ন প্রত্যয়। রহিমপুরের সুরক্ষিত শ্রেণির আধিপত্য একটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এই উন্নয়নের চেষ্টায়।

গণতন্ত্রের সঙ্গে গরিবের লেনদেন কেবল উন্নয়নের উদ্যোগ ঘিরে হয় না। আইনি সমদৃষ্টিকে সামাজিক সাম্যে পরিণত করার উদ্যোগে আধিভৌতিকের পাশাপাশি গণতন্ত্রের আওতায় আসে আধিদৈবিকও। সরগনায় দেবীমন্দিরের দেখভালের দায়িত্ব কব্জা করেছিলেন উচ্চবর্ণ সুরক্ষিত গোষ্ঠীরা। রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী মন্দির ‘পাবলিক’-এর। আইনি অধিকারের সঙ্গে দেবী-মায়ের সঙ্গে দরিদ্র-সহ সব পাবলিকের প্রত্যক্ষ সম্পর্কের বিষয়ও আসে। আইনবলেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন দরিদ্রতররা। মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের নতুন কমিটিতে অন্ত্যজদের জনসংখ্যায় অনুপাতের বেশি প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হয়। মানব উন্নয়ন সূচকে মর্যাদাবৃদ্ধি মাপার ব্যবস্থা নেই, কিন্তু এক কালে যাঁরা উচ্চবর্ণের কেউ পথ দিয়ে হেঁটে গেলে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হতেন, উচ্চবর্ণের সঙ্গে একাসনে বসতে পারাকেও উন্নয়ন হিসাবেই গণ্য করেন তাঁরা।

গবেষণালব্ধ তথ্যগুলিকে সমাজবিজ্ঞানের নানা তত্ত্ব ও রাজ্য স্তরের বিভিন্ন তথ্যের আলোয় উপস্থিত করেছেন লেখক, কিন্তু সংঘাত বনাম সম্মতি কিংবা ঐতিহ্য বনাম আধুনিকতা জাতীয় দ্বিত্বের খোপে ফেলে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেননি। রাজনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, জাতি, শ্রেণি, সব কিছুকে অস্বীকার করে, সব রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের যে একমাত্রিক বা খুব জোর দ্বিমাত্রিক মূল্যায়নের কাঠামোয় আমরা অভ্যস্ত, সেই একঘেয়েমি থেকে পাঠককে মুক্তি দেয় বইটি। সংঘাত ও সম্মতির যে বিচিত্র মিশ্রণে গরিব মানুষ তাঁদের প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে, তার তথ্যনিষ্ঠ ছবি এঁকেছেন লেখক। ভারতীয় গ্রামীণ সমাজের ‘সারল্য’ নিয়ে যে নাগরিক ভ্রমটি প্রায়শই প্রভাবিত করে আমাদের ভাবনাচিন্তাকে, তা থেকে মুক্তি পেতে এই বই সাহায্য করল অনেকটাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন