সম্পাদকীয় ১

তাঁহার উপরে নাই

গত পাঁচ বছরে সর্বাধিনায়ক শি দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাইয়াছেন, গণতন্ত্রের পথে হাঁটিবার বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁহার নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৭ ০০:৫৪
Share:

উনিশতম পার্টি কংগ্রেসে চিনের প্রেসিডেন্ট জানাইয়া দিয়াছেন, সবার উপরে তিনিই সত্য, তাঁহার উপরে নাই। ‘শি চিনফিং চিন্তা’ পার্টির সংবিধানে স্থান পাইয়াছে, মাও সে তুং এবং দেং শিয়াও ফিং ব্যতীত এই স্বীকৃতি আর কাহারও মিলে নাই। নূতন পলিটব্যুরো এবং তাহার স্ট্যান্ডিং কমিটিতে রদবদলের পরে ইহাও স্পষ্ট যে, শি এখন কোনও উত্তরসূরিকে তৈয়ারি করিবার কথা ভাবিতেছেন না, এমনকী, প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করাইয়া পাঁচ বছর পরে তাঁহার তৃতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। গত পাঁচ বছরে সর্বাধিনায়ক শি দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাইয়াছেন, গণতন্ত্রের পথে হাঁটিবার বিন্দুমাত্র বাসনা তাঁহার নাই। পার্টি কংগ্রেসে তিনি এক ধাপ অগ্রসর হইয়া ঘোষণা করিলেন, শাসনতন্ত্রের অন্য সব মডেল ব্যর্থ হইয়াছে, দুনিয়ার সম্মুখে চিনের পথই শ্রেষ্ঠ পথ। যাঁহারা বলিয়া আসিতেছেন, চিনে অর্থনৈতিক উন্নতির স্বাভাবিক পরিণামে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক চাহিদা ক্রমশ প্রবল হইবে এবং তাহার ফলে পার্টির একদলীয় শাসন এ বার ভাঙিবে, তাঁহাদের জন্য এই পার্টি কংগ্রেস কোনও সুসংবাদ দেয় নাই। বরং দেশে দেশে, এই দেশেও প্রবল এবং একাধিপত্যবাদী রাষ্ট্রনায়কের যে উত্থানপর্ব চলিতেছে, প্রতিবেশী মহানায়ক ভ্লাদিমির পুতিনের মতোই শি চিনফিংও সেই ধারায় দিব্য মানানসই।

Advertisement

শি চিনফিং চিন্তার প্রধান প্রতিপাদ্য: সংহতি। দেশের অর্থনীতির বেলাগাম বৃদ্ধির ফলে অসাম্যের অস্বাভাবিক বিস্ফোরণ, বিভিন্ন অঞ্চল ও অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে ভারসাম্যের তীব্র অভাব এবং দুর্নীতির মাত্রাছাড়া প্রসার— বহুমুখী দানবের মোকাবিলায় এক দিকে সরাসরি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাইয়া যাইবেন শি, অন্য দিকে আপাতত ‘মোটামুটি সমৃদ্ধির নিয়ন্ত্রিত লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সংহত করিবেন। এই প্রেক্ষিতেই তাঁহার মনোভাব এবং চিন্তাভাবনার তুলনা করা হইতেছে দেং নহে, মাওয়ের সহিত। কিন্তু সংহত সমৃদ্ধির এই নীতি দেখিয়া কেহ যদি মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে চিন আপন ভূমিকা লাঘব করিতে চাহে, মস্ত ভুল করিবেন। ২০৫০ সালের মধ্যে মহাশক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার সংকল্প জানাইয়া দেয়, দীর্ঘদিন, এমনকী দেং পর্বেও নিজেকে যথাসম্ভব গুটাইয়া রাখিবার যে কূটনৈতিক আদর্শ চিনের ছিল, শি চিনফিং তাহার জাল কাটিতে চাহেন। দক্ষিণ চিন সাগরে অনুসৃত আগ্রাসী নীতির সমর্থনে পার্টি কংগ্রেসের ভাষণে তাঁহার আত্মপ্রশস্তি বলিয়া দেয়, এই প্রশ্নে— দিল্লি কোন ছার— ওয়াশিংটনের আপত্তি বা নিন্দাকেও তিনি বিন্দুমাত্র পরোয়া করেন না।

প্রশ্ন, শি চিনফিং যাহা চাহিতেছেন তাহা পারিবেন কি? তাঁহার প্রধান সমস্যা পার্টিকে সংহত ও অনুগত রাখা। এ যাবৎ সেই কাজে তিনি সফল, কিন্তু অতীত এবং ভবিষ্যৎ এক নহে। মাও জমানার, বস্তুত দেং পর্বের কমিউনিস্ট পার্টি হইতে বর্তমান দলের চেহারা-চরিত্র অনেক আলাদা, অর্থনীতি ও সমাজের বিপুল পরিবর্তন পুরানো আদর্শবাদকে অনেকখানি প্রতিহত করিয়াছে, তাহার পরিবর্তে আসিয়াছে ‘বিড়ালের রং যাহাই হউক, ইঁদুর ধরিলেই হইল’ মানসিকতা। দুর্নীতির বিস্ফোরণের পিছনে তাহার অবদান কম নহে। আজ শি চিনফিং পার্টির সাম্রাজ্য সামলাইবার তাড়নায় সেই ইতিহাসের চাকা কিছুটা থামাইতে এবং কিছুটা উল্টো দিকে ঘুরাইতে চাহিতেছেন। কাজটি অত্যন্ত কঠিন। তাহা জানেন বলিয়াই তিনি সমস্ত ক্ষমতা নিজের নিয়ন্ত্রণে আনিতে এতটা তৎপর। শেষরক্ষা হইবে কি না, আগামী কয়েক বছর বলিবে। তবে চিন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আশা করা যায়, নরেন্দ্র মোদী তাহা জানেন। আশা করা যায়, তিনি চিনের সহিত অযথা টক্কর দিবার বালকসুলভ বাহাদুরি না করিয়া আপন অর্থনীতির শক্তিবৃদ্ধিতে মন দিবেন।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন