Kerala Flood

পরিবেশ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব?

আর্থিক দিক দিয়ে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে, সর্বোপরি ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ বা মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বলা হয় কেরলের ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ শুধু দেশের মধ্যেই সর্বোচ্চ নয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে তুল্যমূল্য।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share:

গত কাল আলোচনা করেছি কী ভাবে পরিবেশবিদদের আপত্তি উপেক্ষা করে উন্নয়নের কাজ চলতে থাকে, এবং ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মধ্যে মানুষকে ঠেলে দেয়। (‘এই বিপর্যয় তো জানাই ছিল’, ৪-৯) কেরলের ঘটনা যেন ফার্স্ট বয়ের হঠাৎ ফেল করার গল্প। সব সময়ই কেরল উন্নয়নের প্রশ্নে, সামাজিক সাফল্যের নিরিখে দেশে প্রথম সারিতে, প্রথমে বললেও অত্যুক্তি হয় না। আর্থিক দিক দিয়ে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে, সর্বোপরি ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ বা মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে বলা হয় কেরলের ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স’ শুধু দেশের মধ্যেই সর্বোচ্চ নয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে তুল্যমূল্য। এমন এগিয়ে থাকা রাজ্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলাতে কেন অনেক পিছিয়ে থাকা রাজ্যদের (যেমন ১৪ নম্বরে থাকা উত্তরাখণ্ড) মতোই ডাহা ফেল করবে?

Advertisement

কথা হল, উন্নত হলেই যে জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়, তা গত বছর আমেরিকার একের পর এক বিপর্যয় প্রমাণ করেছে। বস্টনের মতো শহর, যাকে বিপর্যয় রোধে গোটা বিশ্বে মডেল ভাবা হয়, তাও প্রায় এক সপ্তাহ ভূতের শহরে পরিণত হয়েছিল প্রবল ঝড়ের মুখে। কেরলও তেমন। আসলে কেরলের দিকে আঙুল উঠছে অন্য কারণে। যে ভাবে এ রাজ্যের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে যোগসাজশে পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস করে বিপদকে ঘোর বিপর্যয়ে পরিণত করেছে, সেই কারণে। বিপদ থাকবেই, কিন্তু দেখার বিষয় প্রশাসন তার কাজের মাধ্যমে বিপদের তীব্রতা বাড়াচ্ছে না কমাচ্ছে? প্রশ্ন, যে রাজ্যের মানব উন্নয়ন সূচক এত উন্নত, সেই রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায়, তাদের কাজকর্মে, সেই উন্নয়নের কোনও প্রতিফলন নেই কেন? কেন যে কোনও গড়পড়তা রাজ্যের মতো কেরলের সরকারও উন্নয়ন বলতে বুঝবে খনি, খাদান, বহুতল বানানো ও তার থেকে ভোটের রাজনীতির রসদ সংগ্রহ করা? কেন জীবনযাপনের মান, পরিবেশ সংরক্ষণ বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় পিছনের সারিতে চলে যাবে?

ক্ষমতায় পৌঁছে গেলে সব মুখের চেহারাই এক রকম হয় এমন সরলীকৃত (কিন্তু সঠিক) উত্তরের পাশাপাশি কারণ খুঁজতে আরও একটু গভীরে ঢুকতে হবে। কেরল থেকে বহু মানুষ, প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকেই, কাজের খোঁজে বিদেশে, বিশেষ করে আরব দেশগুলিতে যান ও সেখান থেকে বড় অঙ্কের টাকা উপার্জন করে দেশে পাঠান। বস্তুত কেরলের আর্থিক উন্নতির পিছনে এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। কী ভাবে ব্যবহার হয় এই কুরিয়ার ক্যাশের বড় অংশ? শোনা যায়, যা টাকা বিদেশ থেকে আসে তার অধিকাংশই খরচ হয় বিশাল বাড়ি বানাতে আর বাকিটা সোনা কিনতে। এই প্রবণতাই কেরলে জন্ম দিয়েছে রিয়াল এস্টেট ব্যবসার রমরমার, যাকে হাওয়া দিচ্ছে পরিবেশকে পিছনে ফেলা সরকারি নীতি (নাকি দুর্নীতি)।

Advertisement

প্রসঙ্গত বাংলা থেকে, বিশেষ করে সুন্দরবনের মতো প্রান্তিক অঞ্চল থেকে, যে অজস্র মানুষ প্রতি বছর কাজের খোঁজে রাজ্যের বাইরে যান, তাঁদের অধিকাংশেরই ঠিকানা হয় কেরল। এখানে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় টাকা বেশি পাওয়া যায়। ‘‘এ এক আশ্চর্য সমাপতন। সুন্দরবন থেকে অধিকাংশ মানুষ কাজের খোঁজে যায় কেরলে, আবার কেরলের নিজের মানুষ যায় আরবে। দু’জায়গার আর্থিক ক্ষমতায় আকাশপাতাল প্রভেদ, অথচ বিপর্যয়ের মুখে কোচি ও কুমিরমারি এক হয়ে গিয়েছে’’, জানালেন কেরলে কাজ করতে যাওয়া এক কর্মী। আর অজান্তে তুলে দিলেন এক জরুরি প্রশ্ন। এ কেমন হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স যা পরিবেশকে পাত্তা দেয় না?

জিডিপি-কেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ভাবনাচিন্তার বিকল্প হিসাবে নব্বইয়ের দশকে সামনে আসা হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স গোড়া থেকেই স্বাস্থ্য বা শিক্ষার মানকে হিসেবের মধ্যে ধরলেও পরিবেশকে ধরেনি। সামগ্রিক ভাবে পরিবেশ নিয়ে ভাবনা সত্তর দশকে শুরু হলেও, তা গতি পায় নব্বই দশকের শেষ থেকে। আর জলবায়ু পরিবর্তন তো কল্কে পেয়েছে ২০০৯ থেকে। ফলে ওই ‘ইনডেক্স’-এ যে পরিবেশ নেই, সেটা আশ্চর্যের নয়। স্বয়ং অমর্ত্য সেন, যিনি এই ইনডেক্স তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তিনিও পরবর্তী কালে এই দুর্বলতা স্বীকার করেন। আর এক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটস ও ফরাসি অর্থনীতিবিদ জ্যঁ পল ফিতুসি তাঁদের ‘মিসমেজ়ারিং আওয়ার লাইভস’ বইটিতে ‘ভাল থাকা’ কী ভাবে মাপা যাবে, তা বলতে গিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নকে, এমনকি ইকোলজিক্যাল ফুটপ্রিন্টকেও। কিন্তু কেরল এই প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলিকে নিজস্ব রাজনীতিতে ব্রাত্য করে রাখল, কোটি কোটি মানুষকে ঠেলে দিল বিপন্নতার হাইওয়েতে; কত দিনের জন্য কেউ জানে না।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন