নাবালিকা বিয়ে নয়, সুমনা-অন্নপূর্ণাদের হাত ধরে বদলে যাচ্ছে বালিদ্বীপ

এমন যে কঠিন ঠাঁই, সেখানে মেয়ে ‘পড়তে চাই’ বললেই হল? বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হল, বিয়ে ভাঙলে বাপ-মা-মরা মেয়ের দায়িত্ব নেবে না পরিবার।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৮ ১৭:৫৯
Share:

মাধ্যমিকের সময়ে বিস্তর কান্নাকাটি করে বিয়ে রুখেছিল অন্নপূর্ণা (ছবিতে)। উচ্চমাধ্যমিকের পরে বিয়ে ঠিক হতে সে যখন ফের বেঁকে বসল, বাড়ির লোক বেজায় চটে গেল। মেয়ের বিয়ে কি সোজা? জল-জঙ্গলের জায়গা গোসাবা ব্লকের বালিদ্বীপ। গদখালি থেকে ডিঙিতে দুর্গাদোয়ানি পার করতে হয়। কাজ বলতে মাছ ধরা, নইলে মধু-কাঠের খোঁজে বনে যাওয়া। মণ্ডলপাড়া, আদিবাসীপাড়া, খ্রিস্টানপাড়ায় বাঘের থাবার চিহ্ন বৈধব্যের বেশে। খিদের জ্বালায় শালুক তুলতে গিয়ে কত মেয়ে যে সাপের কামড়ে মরেছে, তার হিসেব কেউ রাখে না।

Advertisement

এমন যে কঠিন ঠাঁই, সেখানে মেয়ে ‘পড়তে চাই’ বললেই হল? বাড়ি থেকে বলে দেওয়া হল, বিয়ে ভাঙলে বাপ-মা-মরা মেয়ের দায়িত্ব নেবে না পরিবার। যাঁরা কলেজে পড়াতে চান, দায়িত্ব পাড়ার সেই সব মেয়ে, স্কুলের সেই শিক্ষকদের।

অগত্যা বিজয়নগর আদর্শ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকুমার পারিয়া আর তাঁর স্ত্রী বাড়িতে আনলেন অন্নপূর্ণাকে। কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় অন্নপূর্ণা ভর্তি হল বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছর সে সংস্কৃতে এমএ পাশ করল, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে। নারী দিবসের অনুষ্ঠানে রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী, মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়, বালি ২ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান, গোসাবা থানার সেকেন্ড অফিসার যখন হাততালি দিচ্ছিলেন, ভারি লজ্জা পাচ্ছিল অন্নপূর্ণা। একটু পরেই সে সবার সঙ্গে অভিনয় করল একটি নাটকে। দেখাল, কেমন করে নাবালিকা বিয়ে আটকাচ্ছে বালিদ্বীপের মেয়েদের সংগঠন ‘বিজয়নগর দিশা’। এখন যার অন্যতম সদস্য অন্নপূর্ণা মণ্ডল।

Advertisement

পড়া ছাড়িয়ে মেয়ের বিয়ে, এই বিপদের বাঘ ঘোরে বাংলার গ্রামে গ্রামে। আয়লার ঝাপটায় তা লাফিয়ে বা়ড়ল বালিদ্বীপে। স্কুলে আসা বন্ধ হল বহু মেয়ের। ২০১২ সালে বালি ২ পঞ্চায়েতের সতেরোটি গ্রামে সমীক্ষা করে ভয়ানক ছবি পেল দিশা। মুসলিম, আদিবাসী মেয়েদের বিয়ের গড় বয়স ১৫, দলিতদের ১৬, বর্ণহিন্দুদের ১৭ বছর। নাবালিকা বিয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দিশার মেয়েদের কী না সহ্য করতে হয়েছে তখন। ‘‘ফোনে রোজ হুমকি আসত, গ্রাহ্য করিনি’’, বলেন সম্পাদক তাপসী মণ্ডল। ‘‘কিন্তু চরিত্র নিয়ে কুৎসা শুরু করতে ভেঙে পড়েছিলাম। স্বামী তখন পাশে ছিলেন।’’ বছর পনেরো আগেও দ্বীপের এক জন কী দু’জন মেয়ে কলেজে ভর্তি হতেন। এখন বালিদ্বীপের দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েতের জনা পঞ্চাশ মেয়ে কলেজ-পড়ুয়া।

ধাক্কা আসে নানা দিক থেকে। দিশা একটি বিয়ে বন্ধ করল, মাস না ঘুরতে বিয়ে দিল পরিবার। পাড়ার লোকে বলল, ‘‘এত থানা-পঞ্চায়েত দেখাচ্ছিলে, তারাই তো খেয়ে গেল।’’ সে কথা বলতে গেলে এখনও মুখ কালো হয় মেয়েদের। গত বছর অবশ্য গোসাবা থানার সহায়তায় সিভিক ভলান্টিয়ারদের নিয়ে একটি কর্মশালা করেছেন তাপসীরা। উর্দি-পরা রাহুল পারিয়া জানালেন, গত বছর দু’টি বিয়ে আটকেছেন, ষোলো ও এগারো বছরের দুই মেয়ের। পুরোহিত, ডেকরেটার, লাইটম্যানদের কর্মশালাও করেছে দিশা।

নাবালিকার বিয়ে কমেছে, কিন্তু বন্ধ হয়নি। পরিবার অন্য দ্বীপে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে বিয়ে দেয়। পালিয়ে বিয়ে করে কেউ কেউ। তবু ছবি বদলাচ্ছে। দশম শ্রেণির বিদিশা মাইতি, সুমনা সাহু জানাল, ‘‘আমাদের ক্লাসে ছেলের চাইতে বেশি মেয়ে।’’

নারী দিবসের অনুষ্ঠানে বিদিশার মতো মেয়েদের অনন্যা চক্রবর্তী বললেন, ‘‘শিক্ষার অধিকার যেমন রয়েছে তোমাদের, তেমনই রয়েছে সুরক্ষার অধিকার।’’ বালিদ্বীপের মেয়েরা ক্লাসঘরের দেওয়ালে টাঙিয়েছে তিনটি সংসদের মানচিত্র। এলাকার মহিলা ও কিশোরীরা মিলে তৈরি করেছে ‘সেফটি ম্যাপ।’ কোন কোন রাস্তা নিরাপদ নয়, দেখানো লাল রেখা দিয়ে। লেখা আছে কোথায় মদের দোকান, চায়ের দোকানে জটলা, আলো নেই, কিংবা গাড়ি মেলে না সন্ধ্যার পর।

স্কুলে যাওয়া-আসার পথে হয়রানি গ্রামের মেয়েদের নিত্য অভিজ্ঞতা। বালিদ্বীপও ব্যতিক্রম ছিল না। ‘‘সাহস বাড়ছিল ছেলেদের। আগে বড়দের দেখলে লুকিয়ে পড়ত, ইদানীং কেয়ার করছিল না’’, বললেন সুকুমারবাবু। দিশার মেয়েদের সঙ্গে মিটিং-এর পর বালিদ্বীপের সিভিক ভলান্টিয়াররা ঠিক করলেন, স্কুল শুরু-শেষ, এবং টিফিনের সময়ে স্কুলের সামনে সাইকেল নিয়ে ছেলেদের দাঁড়াতে দেবেন না। কিছু ছেলেকে থানাতেও আনতে হয়েছে। ‘‘দু’বছর আগেও যে অবস্থা ছিল, এখন অনেকটা রুখে দেওয়া গিয়েছে’’, দাবি তাঁদের।

কী করে এমন বদলাচ্ছে প্রত্যন্ত বালিদ্বীপ? সুমনা সাহু বলল, ‘‘একা বললে তো কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই মিলে গিয়ে বললে তখন শুনবে।’’ দিশায় স্কুলছাত্রী দলের লিডার সুমনা। তার শেষ কথা, ‘‘কাউকে ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে আমি নই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন