Women

চিতার অগ্নি থেকে প্রাণের প্রদীপ

পুলিশের চারটে গুলিতে চারটে ঠাকুর যদি বা মরে যায়, তাতে উত্তরপ্রদেশের শহর-গ্রামে বাল্মীকি (মেথর) গোষ্ঠীর মেয়েদের উপর যে অবিচ্ছিন্ন অত্যাচার চালাচ্ছে ঠাকুরগোষ্ঠী, সে সত্যটা প্রতিষ্ঠা হবে কি? 

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০২০ ০০:০১
Share:

ভাঙা কাচ লাগানো পাঁচিল দেখেছেন? আর সেই পাঁচিলে কী ভাবে হেঁটে যায় বেড়াল? উত্তরপ্রদেশের গ্রামে জ্বলে যাচ্ছে এক দলিত মেয়ের দেহ, দেখার পর মনটা তেমন করে বাইশ বছর হেঁটে পৌঁছে গেল পুরুলিয়ার এক আদিবাসী গ্রামে। খেড়িয়া শবরদের গ্রাম, সেখানে থাকতেন বুধন শবর। এক দিন সাইকেলে করে বৌ শ্যামলীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, রাস্তায় পুলিশ ধরল বুধনকে। পুলিশ হাজত, জেল হাজতে চলল দুর্দান্ত প্রহার। চুরির দায়ে। সাত দিনের দিন প্রাণটা বেরিয়ে গেল। পুলিশ ময়নাতদন্ত করে দেহ কবর দিয়ে দিল। বলল, আত্মহত্যা।

Advertisement

কিন্তু শেষ হল না বুধন। রাতের অন্ধকারে দেহ তুলে আনা হল। বুধনেরই ঘরে গর্ত খুঁড়ে দেহ রেখে, মাটি ফের সমান করে দেওয়া হয়। উপরে বিছানা। যত দিন না হাইকোর্ট থেকে দ্বিতীয় পোস্টমর্টেমের অর্ডার বেরোল, সেখানে শুতেন শ্যামলী। এই প্রতিবেদককে শ্যামলী নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিলেন জায়গাটা। দ্বিতীয় পোস্টমর্টেম প্রতিষ্ঠা করেছিল সত্য, পুলিশি প্রহারে মৃত্যু।

আজ যদি কেউ প্রশ্ন করে, আড়াই দশকের সাংবাদিক জীবনে কী দেখলে? তার উত্তর, পুলিশের সঙ্গে মেয়েদের লড়াই। এই একটা যুদ্ধ দিয়ে ভারতের সব যুদ্ধ চেনা হয়ে যায়। দলিতের মর্যাদার লড়াই, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জঙ্গল-খনি দখলের সংঘাত, ন্যায্য মজুরির দাবি, ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা— হিংসার শেষ যেখানে, সেখানে পুরুষরা পলাতক, বন্দি বা নিহত। পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেয়েরা। খাদান মালিক বা জমির মালিক ধর্ষণের নিমিত্তমাত্র। পুলিশ যাকে মেরেই রেখেছে, তার দেহের উপর দুষ্কৃতী কেবল ঝান্ডা পুঁতে আসে। তার পর? তার পর মেয়েরা নিজের ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে, কিংবা সন্তানের দেহ নিয়ে, সেই পুলিশের কাছেই নালিশ লেখাতে যায়। শুরু হয় আর এক নালিশের পালা, পুলিশ এফআইআর নিচ্ছে না।

Advertisement

নিজের গণধর্ষণের বিরুদ্ধে যিনি প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, সেই ভাঁওরি দেবীর কথাও বাতিল করেছিল পুলিশ। গত বছর পুণেতে এক আলোচনায় বৃদ্ধা ভাঁওরি দাপুটে গলায় বলছিলেন, “আমাকে পুলিশ বলল, তুমি জানো রেপ কাকে বলে? আমি বললাম, চলো আমার সঙ্গে পাশের ঘরে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি রেপ কাকে বলে।” ভাঁওরি তখন ছেলেমেয়ের মা। ভাঁওরির ধর্ষকরা আজ পর্যন্ত সাজা পায়নি। “কিন্তু আমার মেয়েরা তো ন্যায় পেয়েছে,” বললেন ভাঁওরি। আজ যে সরকারি বা কর্পোরেট অফিস, স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েদের প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিকার করতে বাধ্য, তার উৎস ভাঁওরির মামলার রায়। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির প্রতিরোধে আইনও হয়েছে (২০১৩)। তেমনই, আজ মেয়েদের ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা ধরে নিতে হয় আদালতকে, যত ক্ষণ না মিথ্যা প্রমাণিত হচ্ছে। মহারাষ্ট্রের এক নাবালিকা আদিবাসী কন্যা মথুরার ধর্ষণ (১৯৭২) নিয়ে দেশজুড়ে যে হইচই পড়েছিল, তার জেরে মেয়েদের মুখের কথার সম্মান প্রতিষ্ঠা করে আইন হয়েছিল (১৯৮৩)।

এই হয়। দলিত-আদিবাসী, খনিমজুর-খেতমজুর মেয়েদের কথাকে ‘সত্য’ বলে মানতে হলে, তাদের কথার ওজন উচ্চবর্ণ, বিত্তবান পুরুষদের কথার সমান বলে ধরতে হলে, সমাজব্যবস্থার চেনা ছক আর ধরে রাখা যায় না। তাই এত পরিশ্রম করে ধর্ষণ করতে হয় পুরুষদের। ধর্ষণ তো আসলে একটা প্রকাণ্ড ধমক— চোপ রহো! মেয়েগুলোও বেয়াড়া। কোথায় চুপ করে যাবে তা না, আবার ধর্ষণ নিয়ে চেঁচামেচি জোড়ে। গায়ে আগুন দেয়, অনশনে বসে, যাতে পুলিশ কেস নেয়। মেরে দিলেও দেহটা রেখে যায়, যাতে ক্ষতচিহ্নের অক্ষরে পড়া যায় অপরাধের বিবরণ। বেচারি পুলিশ আর কী করে, সত্যের উপর দখল বজায় রাখতে দেহের দখল নেয়। বুধন শবরকে পুঁতে দেওয়া থেকে হাথরসের মেয়েটিকে পুড়িয়ে দেওয়া, সেই এক ডিউটি করে যাচ্ছে। আর প্রাচীন গ্রিসের সেই জেদি রাজকুমারীর মতো, নখে মাটি খুঁড়ে দেহ উঠিয়ে আনছে মেয়েরা।

তাতেও ভয় পায় পুলিশ। তাই এ বার বিচারকেই জ্যান্ত পুঁতে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। রব উঠেছে, হায়দরাবাদের অভিযুক্তদের মতো হাথরসের খুনিদেরও মেরে দাও। এক নেতা তো প্রকাশ্যে এমন আশ্বাসও দিয়েছেন যে, চিন্তা নেই, উত্তরপ্রদেশে এনকাউন্টার হবেই। কী আশ্চর্য! পুলিশের চারটে গুলিতে চারটে ঠাকুর যদি বা মরে যায়, তাতে উত্তরপ্রদেশের শহর-গ্রামে বাল্মীকি (মেথর) গোষ্ঠীর মেয়েদের উপর যে অবিচ্ছিন্ন অত্যাচার চালাচ্ছে ঠাকুরগোষ্ঠী, সে সত্যটা প্রতিষ্ঠা হবে কি?

ওরা কারা, যারা বলে— ধর্ষককে আদালতে তোলার দরকার নেই, তাদের এখনই গুলি করো, প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দাও? তারা মেয়েদের শত্রু। তারা চাপা দিতে চায় যে, ধর্ষণ কেবল ধর্ষক করে না। চারটে লোককে মেরে কী হবে, যদি পুলিশ না কবুল করে যে তারা অসত্য, অন্যায়ের পক্ষ নিয়েছিল? ‘ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি,’ কেন তড়িঘড়ি ঘোষণা করে পুলিশ? কেন ধর্ষকের সঙ্গে সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়, চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে? আগাগোড়া মেয়েদের বিপক্ষে খেলে, শেষে এনকাউন্টার করে রেফারি সাজতে চায় পুলিশ। এটা ন্যায়?

মেয়েদের উপর যা করা হয়, তা ভয়ানক। কিন্তু মেয়েরা যা করতে পারে নিজের জন্য, অন্যের জন্য, সেই শক্তির কাছে ধর্ষক-খুনির শক্তি কিছুই নয়। চিতার আগুন থেকে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে নিতে পারে যারা, তারাই মেয়ে। একটা পুরুষও মরবে না, দগ্ধ হবে পুরুষতন্ত্র।

ভারতের মেয়েরা রাষ্ট্রকে কাঠগড়ায় তুলেছে বহু বার, আবার তুলবে। ‘এনকাউন্টার’ করে কাপুরুষ। যদি পৌরুষ থাকে, তবে দাঁড়াক রাষ্ট্র, তার শতসহস্র ধর্ষিত কন্যা আর তাদের মায়েদের সামনে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন