তাঁদের শ্রমের উপার্জন এই রোগ

প্রতি দিন বিষাক্ত সিলিকা গুঁড়ো ওঁদের শরীরে ঢুকে ফুসফুস দুটো ক্রমশ ঝাঁজরা করে ফেলে। দেখা দেয় মারণ রোগ ‘সিলিকোসিস’।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৩৮
Share:

ওঁরা বিছানায় পড়ে ধুঁকলে, মারা গেলে কারও কিছু আসে-যায় না। কারণ পাথরখাদানের শ্রমিকরা বেঁচে থেকেও ‘নেই’। অদৃশ্য। হদ্দ গরিব, না আছে চালচুলো, না আছে পরিচয়পত্র। কাজ অবৈধ পাথর খাদান বা কারখানায়, সরকারি খাতায় যার অস্তিত্বই নেই। কাজের জায়গাই যেখানে ‘নেই’, সেখানে আবার শ্রমিক থাকে কী করে?

Advertisement

তাই প্রতি দিন বিষাক্ত সিলিকা গুঁড়ো ওঁদের শরীরে ঢুকে ফুসফুস দুটো ক্রমশ ঝাঁজরা করে ফেলে। দেখা দেয় মারণ রোগ ‘সিলিকোসিস’। শ্রমিকদের প্রাপ্য সরকারি চিকিৎসা যেমন ওঁরা পান না, তেমনই রোগ নিবারণের জন্য স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ তৈরির চেষ্টাও দেখা যায় না। কেন্দ্র বা রাজ্য, কেউ জানে না, কত মানুষ সিলিকোসিস আক্রান্ত, কত মারা গিয়েছেন। তবে ২০১১ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সংসদে পেশ করেছিল একটি বিশেষ রিপোর্ট। যা বলছে, পাথর ভাঙার বৈধ কারখানাগুলিতে কর্মরত প্রায় এক কোটি শ্রমিক এই রোগের শিকার। অবৈধ কারখানার মজুরদের হিসেব অবশ্য তাতে ছিল না।

সেই সংখ্যার আন্দাজ পেতে এ রাজ্যে সমীক্ষা করেছে ‘সিলিকোসিস আক্রান্ত সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি’। গত বছর তৈরি হয়েছে, প্রায় তিনশো পাথর-শ্রমিক এর সদস্য। আছেন চিকিৎসক, শিক্ষক-সহ নানা পেশার মানুষও। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে এক বছর ধরে তাঁরা সমীক্ষা করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, সিলিকোসিসে আক্রান্ত শ্রমিকের সংখ্যা ৬৩৭। ২০১১-২০১৯ সালের মধ্যে ওই রোগে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের (তখনও হাসানুরের মৃত্যু হয়নি)। অনেকের ডেথ সার্টিফিকেটে সিলিকোসিসের উল্লেখ রয়েছে।

Advertisement

১৭ জুন উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয় গোয়ালদহ গ্রামে চল্লিশ বছরের হাসানুর মোল্লা সিলিকোসিসে মারা গেলেন। তাঁর দুই দাদাও একই রোগে গিয়েছেন। একটি সমীক্ষা বলছে, শুধু গোয়ালদহতেই ২০১১ সাল থেকে এই নিয়ে ২৮ জনের মৃত্যু হল এই রোগে। এখনও গ্রামে পাঁচ জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ ও কোর্টের নির্দেশে এদের মধ্যে মাত্র ন’টি পরিবার ক্ষতিপূরণের চার লক্ষ টাকা পেয়েছে। মিনাখাঁ, সন্দেশখালি ১ ও ২, ক্যানিং ১ ও ২, দেগঙ্গা, হাড়োয়া, ভাঙড়, বারাসত জুড়ে পাথর-শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়েছে রোগ। গত এপ্রিলে সংগ্রামী শ্রমিক কমিটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে রাজ্য শ্রম দফতর ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনে (আইএলও)।

তাতে পরিস্থিতি বদলাবে, এমন আশা কম। কমিটির সঙ্গে জড়িত তাপস গুহ জানালেন, অসংগঠিত, বেআইনি পাথর খাদান বা পাথর ভাঙার কারখানার বিষয়টি বাম সরকার বা তৃণমূল সমান ভাবে এড়িয়ে গিয়েছে। কারখানার মালিকদের থেকে নেতাদের উপরি রোজগার কমে যাবে। সরকারি খাতায় কয়েক লক্ষ শ্রমিক বেড়ে যাবে। তাদের শ্রমিকের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা, বা মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অতএব কারখানা এবং তার শ্রমিক অদৃশ্য থাকাই ভাল। বীরভূমের নলহাটি, রামপুরহাট, মহম্মদবাজার, পাঁচামি, পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল, জামুরিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও উত্তর ২৪ পরগনায় অগণিত বেআইনি পাথর ভাঙার ছোট ছোট ইউনিট চলছে। ২০১২ সালে এক বৈঠকে বীরভূম আদিবাসী সংগঠন জানিয়েছিল, শুধু ওই জেলাতেই দু’হাজার পাথর ভাঙার ইউনিট, এবং আটশোটি ছোট পাথর খাদান রয়েছে।

দীর্ঘ দিন এই শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করছেন চিকিৎসক জয়ন্ত ভট্টাচার্য। জানালেন, ‘এটা পেশাগত রোগ (অকুপেশনাল ডিজ়িজ়)। যাঁরা পাথর ভাঙেন, বা সিমেন্টের বস্তা ঝাড়েন তাঁদের হয়। রোগ রুখতে এমন ভাবে যন্ত্র তৈরি করতে হবে যাতে ধুলো না ওড়ে। বা শ্রমিকদের উপযুক্ত পোশাক ও মাস্ক দিতে হবে। সে কথা ভাবছে কে?’ ভারতে ‘সিলিকোসিস নির্মূল করার জাতীয় কর্মসূচি’ বিশ বাঁও জলে, বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট।

কিছুটা রোগ প্রতিরোধ হয় কাজের পর স্নান করে কাপড় বদলে নিলে। সমস্যা কারখানায় জলাভাব, পাল্টানোর মতো দ্বিতীয় জামার অভাব। তাই শ্রমিকদের বিপন্নতা কমে না, বললেন জয়ন্তবাবু। তাঁর অভিজ্ঞতায়, বহু চিকিৎসক রোগটিকে যক্ষ্মা বা ক্যানসারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে ভুল চিকিৎসা করেন। আক্রান্তরাও অনেক বিলম্বে চিকিৎসকের কাছে আসেন। তখন কিচ্ছু করার থাকে না।

স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য জানিয়েছে, বীরভূমের মহম্মদবাজার ও উত্তর ২৪ পরগনার মিনাখাঁয় সিলিকোসিস-আক্রান্তদের স্ক্রিনিং ও এক্স-রে শুরু হয়েছে। মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের মতো জেলায় আক্রান্তদের সহায়ক চিকিৎসাও হচ্ছে। তবে তা সত্যি পাচ্ছে ক’জন? প্রয়োজনের তুলনায় তা কতটুকু? আর কোনও শ্রমিকের যাতে এ রোগ না হয়, তার দায় নেবেন কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন