আজীবন ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা

১৯৪৯ সালে, প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি একটি আদর্শে স্থির ছিল, দল এবং সরকার উভয়ই জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, জনগণের স্বার্থেই কাজ করবে, কোনও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।

Advertisement

পলাশ পাল

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৫৩
Share:

প্রেসিডেন্টের মেয়াদ তুলে দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের সদস্যরা। চিনে শাসনতন্ত্রের এই পরিবর্তন শি চিনফিং-এর সামনে ‘আমৃত্যু’ ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তৈরি করেছে। আক্ষরিক অর্থেই শি চিনফিং এর ফলে হয়ে উঠেছেন দেশের সর্বময় কর্তৃত্বসম্পন্ন শাসক। তিনি চিনের ‘আজীবন প্রেসিডেন্ট’, কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক, সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের প্রধান। স্বাভাবিক ভাবেই এক জন মাত্র ব্যক্তির হাতে এত বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণকে ঘিরে চিন এবং বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে নানা রকম তর্ক ও বিতর্ক। প্রশ্ন হল, আমরণ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকলে শি চিনফিং কি ইতিহাসে মহানায়কের সম্মান পাবেন?

Advertisement

১৯৪৯ সালে, প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই, চিনের কমিউনিস্ট পার্টি একটি আদর্শে স্থির ছিল, দল এবং সরকার উভয়ই জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে, জনগণের স্বার্থেই কাজ করবে, কোনও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। বিভিন্ন সময়ে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মোটের ওপর নীতি হিসাবে তা টিকে ছিল। শি চিনফিঙের একচ্ছত্র ক্ষমতা সেই আদর্শের প্রতি একটি বড়সড় ধাক্কা নিঃসন্দেহে। পাশাপাশি কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের অসীম ক্ষমতায় হ্রাস টানতে, এবং মাও যুগের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে উদ্ভূত বেদনাদায়ক পরিস্থিতির প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে, ১৯৭৯ সালে, দেং শিয়াও পেঙের নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল যৌথ নেতৃত্বের ধারণা। শাসনতন্ত্রের এই পরিবর্তন সেই সম্মিলিত নেতৃত্বের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে আবার পুরনো ব্যবস্থার ওপরেই আস্থা রাখল। সেই সঙ্গে, ১৯৭৯ সাল-পরবর্তী বিধিবিধান দলের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনার লড়াইকে অনুমোদন দিয়েছিল, তা-ও অস্বীকার করা হল।

২০১২ সালে দলের এবং ২০১৩ সালে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর থেকেই নিজের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে সক্রিয় থেকেছেন শি চিনফিং। দেশ জুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সুযোগে দল এবং সরকারের মধ্যে থাকা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হটিয়ে দিয়েছেন। ছাঁটাই হয়েছেন নিম্ন স্তরের আমলা থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরের হাজার-হাজার দলীয় নেতা-কর্মী। বহু উচ্চ পদস্থ নেতাই এখন দিন কাটাচ্ছেন জেলে। তাঁর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সুশীল সমাজের কণ্ঠ রোধ করার অভিযোগও রয়েছে। জনসাধারণের গতিবিধি সম্পর্কে ধারণা পেতে চিনের সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েইবো-র ওপরে নজরদারি বাড়িয়েছে শি চিনফিঙের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন, এই অভিযোগও নতুন নয়। বিশ্বের বহু একনায়কের পতনের অন্যতম কারণ, জনগণ কী ভাবছে তার আসল চিত্র শাসকের কাছে যথা সময়ে না পৌঁছনো। তাই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কারা তাঁর সরকারের সমর্থক, কারা ভিন্নমতাবলম্বী ইত্যাদি খবরাখবর পেতেই এই সব ব্যবস্থা আগেভাগেই করে রাখছেন তিনি, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

তবে শি চিনফিং চিনকে যতই বজ্র আঁটুনিতে বেঁধে রাখতে চান, ইতিহাস কিন্তু বার বার প্রমাণ করেছে যে, শাসকের ক্ষমতার মেয়াদের বিষয়টি জনগণের অনুমোদনের ওপরই নির্ভরশীল। ইতিহাস যেমন বহু গণতান্ত্রিক শাসককে মহানায়কের আসন দিয়েছে, তেমনই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা অ-জনপ্রিয় স্বৈরশাসকের প্রতি নির্দয় হয়েছে। শি চিনফিং প্রকৃত অর্থেই একনায়ক কি না, তাত্ত্বিক ভাবে সেই বিতর্ক চলতেই পারে। তবে কোনও উচ্চাভিলাষী শাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়লে তা যে স্বৈরাচারী শাসনের পথকেই প্রশস্ত করে, ইতিহাসে এই নজির অসংখ্য। পৃথিবীর বহু একনায়কই জনমতকে অগ্রাহ্য করে আমরণ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছেন, তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদের পরিণতি ভাল হয়নি। হয় তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, নয়তো দলই তাঁদের পরিত্যাগ করেছে। এমনকী বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতা দখল করা সামরিক শাসকদের অবস্থাও অন্য রকম হয়নি।

১৭৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফ্রান্সের ক্ষমতা দখল করেছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে তিনি নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন আজীবনের শাসক। কিন্তু এক দশক অতিক্রম করতেই তাঁর জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। ফ্রান্স ও গোটা ইউরোপে তাঁর স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রবল জনমত। ১৮১৪ সালে পতন হয়েছিল নেপোলিয়নের। একই কথা বলা চলে প্রিন্স মেটারনিক সম্পর্কে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দমন করে দীর্ঘ ৪০ বছর ইউরোপকে নিয়ন্ত্রণ করেন অস্ট্রিয়ার এই রক্ষণশীল নেতা। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রবল ঝড়ে তাঁকেও ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়। ঠিক সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যর্থতার মূল্য দিতে হয় মাও জে দং-কেও, শি নিজেই সেই ঘটনার সাক্ষী। সোভিয়েত ইউনিয়নের জোসেফ স্তালিন আমরণ ক্ষমতায় থাকলেও মৃত্যুর পর তিনি জনগণের সমালোচনার পাত্র হন। ঠিক সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যর্থ হলে নেতাকে নিন্দার ভাগিদার হতেই হয়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ জিম্বাবোয়ের রবার্ট মুগাবে। শেষ জীবনে দলই তাঁর পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়, সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাঁর পতন ঘটে।

গত অক্টোবরে, পার্টি কংগ্রেসের ১৯তম অধিবেশনে, ২০৩৫ সালের মধ্যে চিনকে একটি আধুনিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছিলেন শি চিনফিং। তিনি তাঁর ভাষণে শাসন ব্যবস্থার অন্য সব মডেলকে সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘চিনের পথই শ্রেষ্ঠ পথ’। চিনের বড় অংশের মানুষ এখনও গ্রামে বসবাস করে, শুধু উপার্জনের দিক দিয়েই নয়, শিক্ষা, পরিকাঠামো, সরকারি সেবা-সহ নানা দিক থেকে তাঁরা শহরের মানুষের তুলনায় পিছিয়ে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০৩৫ সালেও চিনের অন্তত ৩০ কোটি মানুষ বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে গ্রামে বাস করবেন। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে উন্নয়নের বাইরে রেখে, জনগণের চলাফেরা ও ব্যক্তিগত অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে চিন কী ভাবে একটি আধুনিক দেশ হয়ে উঠবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে। আধুনিকতা একটি সমন্বিত ব্যবস্থা, সেখানে আয়ের লক্ষ্যে পৌঁছনোটাই শেষ কথা নয়। নাগরিকদের কথা শোনা, তাঁদের চিন্তা-ভাবনাকে শাসনকার্যের অঙ্গীভূত করাও এর সঙ্গে জড়িত। শি চিনফিঙের ভাবনায় তার কোনও প্রতিশ্রুতি নেই।

অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিনের মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতায়ও এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। আধুনিক সমাজের চিন্তাচেতনা নিয়ে বেড়ে উঠেছে তারা। ক্ষমতার মেয়াদ নির্ধারণ, স্বাধীন মতপ্রকাশ, শাসনকার্যে অংশগ্রহণের আকাঙ্ক্ষা সবই আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থারই অঙ্গ। কিন্তু শি যদি এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখান তবে তাঁকে প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবে। ভাটা পড়বে তাঁর জনপ্রিয়তায়। দলের মধ্যেই নানা বাধার সম্মুখীন হবেন তিনি। পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিতে পারে বড় ধরনের অসন্তোষও। শি যে ইতিহাসে মহানায়কের স্থান পেতে উদ্গ্রীব হয়েছেন, সেই স্বপ্ন অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের মত।

শি চিনফিং যদি ইতিহাস-সচেতন শাসক হয়ে থাকেন, তবে ক্ষমতায় থাকার মেয়াদটি জনগণের সম্মতির ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। নতুবা তাঁকে খেসারত দিতে হবে ইতিহাসের দেখানো পথেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন