আগুনের পরশমণি

আজিকার পশ্চিমবঙ্গ যদি এই সাফল্যের অমলিন আলোয় স্নাত হইয়া শুদ্ধ হইতে পারে, তাহাই এই রাজ্যের নিস্তার পাইবার একমাত্র পথ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৯ ০০:৪২
Share:

Madhyamik

দারিদ্র। পরিকাঠামোর অভাব। কুসংস্কার। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। দুর্জয় সব বাধা অতিক্রম করিয়া কতগুলি বিজয়ী মুখ উদ্ভাসিত হইল। এক কামরার ঘরে ঘাড় গুঁজিয়া পড়িয়াছে কেহ, কাহাকে হয়তো নিয়মিত সংসারের কাজও করিতে হইয়াছে, কেহ হয়তো-বা প্রত্যহ দশ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পার হইয়া স্কুলে পৌঁছাইয়াছে। ইহাদের মধ্যে কেহ উচ্চ মাধ্যমিকের মেধা তালিকায় ঠাঁই পাইয়াছে। কেহ ৮০ শতাংশ নম্বরের গণ্ডি অতিক্রম করিয়াছে। কেহ স্টার, কেহ নিতান্ত ফার্স্ট ডিভিশন। কিন্তু, তাহারা প্রত্যেকে জয়ী। জিতিয়াছেন তাহাদের অভিভাবক, শিক্ষক, শুভার্থীরাও। মুড়ি ভাজিয়া, অঙ্গনওয়াড়ির কাজ করিয়াও সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাইয়াছেন মা। পান-সিগারেটের দোকানদার বাবা নিজের আয়ের শেষ কড়িটি অবধি সন্তানের শিক্ষার জন্য ব্যয় করিয়াছেন নির্দ্বিধায়। আবার, মেধাবী ছাত্রের দারিদ্রের কথা শুনিয়া স্কুল বেতন মকুব করিয়া দিয়াছে, শিক্ষকরা নিখরচায় পড়া দেখাইয়া দিয়াছেন, বেসরকারি কোচিং ক্লাসও ন্যূনতম খরচে থাকা-খাওয়া, পড়ার ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে। গ্রামের মাতব্বররা যে মেধাবী মেয়েটিকে ‘দেবী’ সাব্যস্ত করিয়াছিলেন, তাহার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হইয়াছে দেখিয়া শিক্ষিকারা বাড়িতে আসিয়া, সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করিয়া তাহাকে স্কুলে ফিরাইয়া লইয়া গিয়াছেন। মেয়েটির ঝুলিতে ৮০ শতাংশ নম্বর। যে ছেলেটির ভবিতব্য ছিল দিদিমার সহিত কাগজকুড়ানি হওয়া, সহৃদয় পড়শির স্নেহাশিসে আজ সে স্টার পাইয়া পাশ করিয়াছে। সকল কাঁটা ধন্য করিয়া ফুল ফুটিল রাজ্যের হরেক প্রান্তে। আরও এক বার প্রমাণ করিল, যদি সৎ চেষ্টা থাকে, তবে সাফল্য অধরা হয় না।

Advertisement

আজিকার পশ্চিমবঙ্গ যদি এই সাফল্যের অমলিন আলোয় স্নাত হইয়া শুদ্ধ হইতে পারে, তাহাই এই রাজ্যের নিস্তার পাইবার একমাত্র পথ। যে গোত্রের ‘সাফল্যে’ পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ক্রমশই অভ্যস্ত হইয়া উঠিতেছে, গত কয়েক মাস, বিশেষত গত কিছু সপ্তাহের সংবাদপত্রে যে সাফল্যের ফিরিস্তি শিরোনামে থাকিয়াছে, তাহা হইতে নিস্তার বা নিষ্কৃতির সন্ধান অত্যন্ত জরুরি। সাফল্য বলিতে যে ছাপ্পা ভোট দেওয়া অথবা বৈধ ভোটারদের আটকাইয়া রাখা নহে, এলাকা দখল করা, পার্টি অফিস অধিকার করা, বোমা-গুলিতে প্রতিপক্ষকে কাবু করিয়া ফেলা নহে— এমনকি, এক দলের বাহুবলীর অত্যাচার হইতে বাঁচিতে অন্য দলের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়িয়া তোলাও নহে, এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গের ‘নেতৃস্থানীয়’দের কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গ আজ ভুলিতে বসিয়াছে। ভাবিতে ইচ্ছা করে, উচ্চ মাধ্যমিকের কৃতীদের আখ্যানগুলি কি এই রাজ্যকে নূতন করিয়া সাফল্যের অর্থ শিখাইতে পারে? সম্ভাবনা আছে, তবে সে সম্ভাবনা বাস্তবায়িত করিবার জন্য শিখিবার ইচ্ছাও থাকা চাই। সমাজকে আসিয়া এই ছাত্রছাত্রীদের সম্মুখে সবিনয় নতজানু হইয়া বসিতে হইবে। শিখিতে হইবে, কী চাহিতে হয়। ধ্বংস আর সৃষ্টির মধ্যে, সৎ আর অসতের মধ্যে ফারাকের বোধটি অন্তরে জাগাইতে হইবে। বুঝিতে হইবে, শত বাধাতেও, শত প্ররোচনাতেও কী ভাবে সৎ লক্ষ্যে অবিচলিত থাকিতে হয়। যে অভিভাবকরা এই যুদ্ধে সন্তানের সহায় হইয়াছেন, যে শিক্ষকরা বুক দিয়া আগলাইয়াছেন ছাত্রদের, যে সুধী প্রতিবেশী আপন-পরের সঙ্কীর্ণতা ত্যাগ করিয়া মেধাবী ছেলেমেয়েদের পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহাদের নিকটও শিখিবার আছে। তাঁহারা জানাইয়াছেন, কী ভাবে একটি সুস্থ সমাজ গড়িয়া তুলিতে হয়। কী ভাবে শুভকে বরণ করিতে হয়, লালন করিতে হয়। পশ্চিমবঙ্গে এখন এই শিক্ষা অমূল্য। ভাবনাচিন্তা ও মূল্যবোধের অসীম ক্ষুদ্রতা, মারাত্মক সঙ্কীর্ণতা এই রাজ্যকে গ্রাস করিয়াছে। তবুও যে সেই সমাজেই এই সাফল্যের আখ্যানগুলি রচিত হয়, মানুষ মানুষের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়ায়, এই আশার আলোটি এখনও আছে। সেই পবিত্র আলোয় কি পশ্চিমবঙ্গ নিজেকে শুদ্ধ, শুচি করিয়া লইতে পারে না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন