প্রবন্ধ ২

অপারেশন বর্গা যে ক্ষতি করেছে

বামফ্রন্টের অপারেশন বর্গার সাফল্য নিয়ে অনেক প্রচার হয়েছে, কিন্তু অপ্রিয় সত্যটা বলা হয়নি। গ্রামসমাজের সুস্থিতি এর ফলেই নষ্ট হতে শুরু করে। নাসিম-এ-আলম।পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র (‘আমাদের বামপন্থীরা...’, ১০-৬) শিক্ষাক্ষেত্রে, শিল্পায়ন প্রসঙ্গে বামপন্থীদের নীতি নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা একদম ঠিক। কিন্তু অপারেশন বর্গা, ভূমি সংস্কারের প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য পড়ে মনে একটা প্রশ্ন জাগে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share:

পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র (‘আমাদের বামপন্থীরা...’, ১০-৬) শিক্ষাক্ষেত্রে, শিল্পায়ন প্রসঙ্গে বামপন্থীদের নীতি নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা একদম ঠিক। কিন্তু অপারেশন বর্গা, ভূমি সংস্কারের প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য পড়ে মনে একটা প্রশ্ন জাগে।

Advertisement

সত্তরের দশকের শেষ লগ্নে ক্ষমতায় এসে সিপিএম পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকার অপারেশন বর্গা ও ভূমি সংস্কারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। দিনে ও রাতে ঢোল ও বাদ্যসহ দলে দলে পার্টির কর্মীরা ব্যাপক ভাবে জমির দখল নিতে থাকে। জমির পর জমিতে লাল পতাকা পুঁতে দেওয়া হয়। শহরে, বিশেষত কলকাতায় পার্টির সমর্থক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পীদের মনে ধারণা জন্মায় যে, গ্রামে গরিব মানুষ জমি পেয়েছেন, তাঁরা সুখে আছেন। বামপন্থীরা ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পরও পশ্চিমবঙ্গের শহরবাসীরা, যাঁরা চাকরি ও ব্যবসাকে সম্বল করে জীবন যাপন করেন, তাঁদের অনেকের মনে এখনও সেই ধারণা বদ্ধমূল।

স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইন পাশ হয়। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের ঘটনা সে সব। তার পর পশ্চিমবঙ্গে চার-পাঁচশো বিঘা জমির মালিক কেউ ছিলেন না বললেই চলে। নামে-বেনামে বিশাল সম্পত্তি ধরে রাখতে পেরেছিলেন কেউ কেউ, তবে তাঁদের সংখ্যা নগণ্য। অভাবক্লিষ্ট নিরন্ন গ্রামগুলিতে এমনও হয়েছে যে, সর্বাধিক জমির মালিক যিনি, তাঁর জমির পরিমাণ বড়জোর ত্রিশ বিঘা। গ্রামের মানুষ তাঁকেই বড়লোক বলে জানে।

Advertisement

এই ত্রিশ বিঘা জমিও এক মালিকানায় বেশি দিন থাকল না। ভাইয়ে ভাইয়ে জমি ভাগ হল। দুই ভাই হলে জমির পরিমাণ দাঁড়াল পনেরো বিঘা। সন্তান-সংখ্যা বেশি হলে একক মালিকানায় জমির পরিমাণ কমতে থাকে। মেদিনীপুর বা বর্ধমানে কোথাও দু-এক জন জোতদার আছেন, সেই উদাহরণ দিয়ে তো বাঙালি কৃষক সমাজের সামগ্রিক পরিচয় দেওয়া যাবে না। বাঙালি কৃষক চিরকালই গরিব। তাঁদের নব্বই শতাংশের জমির পরিমাণ পাঁচ থেকে দশ বিঘা। এই পাঁচ-দশ বিঘা জমি নিয়ে ধান, গম, সর্ষে, তিল, কখনও দু’ফসলি জমিতে মরসুমি সবজি লাগিয়ে তাঁরা জীবন যাপন করতেন।

অপারেশন বর্গা গ্রামজীবনের সেই নিভৃতি ও সুস্থিতির ওপর বিরাট আঘাত নিয়ে এসেছিল। যিনি জমির অধিকার হারালেন, তাঁর জীবন ও জীবিকার কী হবে? নতুন ব্যবস্থায় পাকাপাকি অধিকার পাওয়ার পরে বর্গাদার জমির মালিককে আর জমির আলের মাথায় দাঁড়াতে দেননি, ফসলের ভাগ দেওয়া তো দূরের কথা। জমির মালিক কখনও পঞ্চায়েত, ব্লক অফিসে অভিযোগ জানিয়ে যদি বা কিছু ধান পেলেন, কিন্তু নিজের জমিতে কতটা ফসল ফলেছে, সেই পরিমাণ তাঁর অজানাই রয়ে গেল। অর্থাত্‌, নতুন ব্যবস্থায় বর্গাদার হাত-তোলা কিছু ফসল দিয়ে জমির প্রকৃত মালিককে সারা বছরের মতো বিদায় করলেন।

জমি হারানো কৃষক সমাজের কেউ পার্টি, রাষ্ট্র অথবা সমাজের শত্রু ছিলেন না। তাঁদের পরিবারে হঠাত্‌ যে অভাব ও অসহায়তা নেমে এসেছিল, তার জন্য তাঁরা দায়ী নন। বর্গায় জমি হারিয়ে অনেকে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে পারেননি। সামান্য গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এক সময় যাঁরা সাধারণ গৃহস্থ ছিলেন, তাঁদের অনেককেই দৈহিক শ্রম দিয়ে জীবন নির্বাহ করতে হয়েছে। আজও এঁরা ভেবে পাননি, কোন অপরাধে সর্বস্ব হারাতে হয়েছে।

জমির অধিকার সূত্রে আশির দশক থেকে গ্রামে গ্রামে অশান্তি ও হানাহানি শুরু। শিক্ষিত মানুষজন দলে দলে গ্রাম থেকে নিকটস্থ শহরে চলে গেলেন। বহু অত্যাচার সহ্য করেও গ্রামে যে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত ভদ্র স্বভাবের মানুষরা এখনও রয়েছেন, তাঁরা রাজনীতিতে আসতে চান না। গ্রামের দখল চলে গিয়েছে অশিক্ষিত একটি শ্রেণির হাতে। যাকে শহর থেকে ‘গরিব মানুষের ক্ষমতা পাওয়া’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই গ্রামীণ বামপন্থী দাদাদের দাপটে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে ক্রমশ।

গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার কৌশল হল বর্গা আইন। লক্ষ্যটা ছিল এই যে, গ্রামে শুধু অতি ক্ষুদ্র কৃষক থাকবে, শ্রমিক থাকবে আর চিরকাল তারা বিপিএল তালিকাভুক্ত হবার জন্য লাইনে দাঁড়াবে। জব কার্ড পেলে নিজেকে ধন্য মনে করবে আর শেষ বয়সে সাতশো টাকার মাসিক বার্ধক্য ভাতা নিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে। গ্রাম মানেই সাহায্যপ্রার্থী গরিবের বাসভূমি। বামপন্থীদের এই মনোভাব গ্রামভিত্তিক উন্নয়নের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।

জমির মালিকের হাতে জমি থাকলে কৃষি ও শিল্পের দ্বার উন্মুক্ত হত। খামার নির্মাণ করে ধান থেকে চাল প্রস্তুত করে সেই চাল শহরে পাঠানো যেত। গ্রামের শ্রীবৃদ্ধি হত। গ্রামের মানুষ গ্রামেই কাজ পেতেন। আজ গ্রামে শীত বা বর্ষা ছাড়া কাজ মেলে না। দক্ষিণবঙ্গের অশিক্ষিত যুবসমাজকে দলে দলে কাজের সন্ধানে অন্যত্র ছুটতে হচ্ছে।

বামপন্থী তাত্ত্বিকরা এই বাস্তবের খবর হয়তো রাখেন না। শ্রদ্ধেয় অশোক মিত্র নেতৃত্ব পরিবর্তনের কথা বলেছেন। নেতৃত্ব পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে, এটা মেনে নেওয়ার পরেও বলা যায়, নেতৃত্বে নতুন যাঁরা আসবেন, তাঁরাও কি গ্রামকে খুব বোঝেন? বুঝলেও, সত্যকে স্বীকার করেন? ‘অপারেশন বর্গা’র সাফল্য নিয়ে মিথ্যা প্রচার ছেড়ে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ানো দরকার।

শ্যাম বেনেগালের ‘আরোহণ’ (১৯৮২) ছবির একটি দৃশ্য। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর সরকারেরই অনুরোধে ও অর্থানুকূল্যে ‘অপারেশন বর্গা’ নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন