প্রবন্ধ ২

আমরা সিকিমের কাছে শিখতে পারি

সিকিমে ‘ধারা বিকাশ’-এর কল্যাণে ঝর্না থেকে জলাশয় আবার জলে ভরে উঠেছে, সারা বছর সে জল থাকছে। পশ্চিমবঙ্গও স্লোগান দিয়েছিল: জল ধরো জল ভরো। পুকুর বিস্তর কাটা হয়েছে। কিন্তু ভূ-জলের স্তর নেমেই চলেছে।সামনে তরতর করে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠে যাচ্ছিলেন মধ্যবয়সিনী মহিলা। দক্ষিণ সিকিমের জেলা সদর নামচি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে পারবিং গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। সঙ্গে পঞ্চায়েতের অন্যান্য সদস্যরা, স্থানীয় কিছু মানুষ আর অঞ্চলের বিডিও। পিছনে সিকিমের জলবায়ু পরিবর্তন বুঝতে গোটা দেশ থেকে আসা জনা পঁচিশ সাংবাদিক।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৩
Share:

সামনে তরতর করে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে উঠে যাচ্ছিলেন মধ্যবয়সিনী মহিলা। দক্ষিণ সিকিমের জেলা সদর নামচি থেকে দশ কিলোমিটার দূরে পারবিং গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। সঙ্গে পঞ্চায়েতের অন্যান্য সদস্যরা, স্থানীয় কিছু মানুষ আর অঞ্চলের বিডিও। পিছনে সিকিমের জলবায়ু পরিবর্তন বুঝতে গোটা দেশ থেকে আসা জনা পঁচিশ সাংবাদিক। এবড়োখেবড়ো পাথর বেয়ে দম সামলাতে সামলাতে মনে হচ্ছিল, এটা তো ঠিক গড়পড়তা সরকারি পাবলিসিটি ইভেন্ট নয়, যেখানে হোটেলের ঠান্ডা ঘরে এলসিডি প্রোজেক্টরের ফেলা ছবিতে ‘কা ভাল প্রকল্প’ বুঝিয়ে কাজ সারেন মুখ্য আধিকারিকরা। ভাবনাটা আরও জোরদার হল পরের কয়েক ঘণ্টায়।

Advertisement

দক্ষিণ সিকিমের একটা বড় অংশ সাধারণ ভাবে খরাপ্রবণ। আমাদের দার্জিলিঙের মতো ওখানকার মানুষও বর্ষা বাদ দিয়ে বছরের বাকি সময়টা প্রবল জলকষ্টে ভুগতেন। বছর দুই আগে অবধি ভুগতেন, এখন আর ভোগেন না। তার কারণ: ধারা বিকাশ। এটি হল জল সংরক্ষণের একটি মডেল। পশ্চিমবঙ্গের ‘জল ধরো জল ভরো’ কর্মসূচির সঙ্গে এর মিল আছে, তবে রূপায়ণে আকাশপাতাল তফাত। এ রাজ্যের মতোই মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ রোজগার যোজনা প্রকল্পের অধীনে থাকলেও পরিকল্পনার স্তর থেকেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সঙ্গী করে এগিয়েছে পারবিং ও বাকি সিকিম। সারা দেশের বিশেষজ্ঞ সংস্থায় ট্রেনিং নিয়ে ট্রেনার তৈরি করা থেকে শুরু করে গোটা অঞ্চলের মাটির তলার জলের অবস্থান ও গতিপথ ঠিক করা এবং তার ভিত্তিতে কোথায় কোথায় বৃষ্টির জল ধরার জন্য কী মাপের ‘ট্রেঞ্চ’ কাটতে হবে তা-ও ঠিক করা।

দু’ধরনের জলাধার; ছোটগুলির মাপ লম্বায় ছ’ফুট, চওড়ায় তিন ফুট আর গভীরতায় প্রায় আড়াই ফুট, আর বড়গুলির গভীরতা একই, কিন্তু দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে দশ ফুট বাই দশ ফুট। সব মিলিয়ে হেক্টর প্রতি প্রায় দশ হাজার ঘনফুট জলাধার তৈরি হয়েছে, যাতে বৃষ্টির জল এদের মাধ্যমে মাটির তলার জলকে সমৃদ্ধ করে। হাতে হাতে ফল পাওয়া গেছে। গত বছরখানেকে পঞ্চাশটির বেশি শুকিয়ে যাওয়া ঝর্না আবার নতুন জীবন পেয়েছে, পাহাড়ের নীচের দিকে থাকা বেশ কয়েকটি জলাশয়ে আবার সারা বছর জল থেকেছে। ‘আমরা তো প্রথমে শুনে হেসেছিলাম, পাহাড়ের ওপর ছোট ছোট ট্রেঞ্চ কাটলে নাকি ঝর্নায় আবার জল আসবে! কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে গেছি, প্রায় ম্যাজিকের মতো এখন সারা সময় ধরে জল, পুকুরেও তাই,’ বললেন গ্রামের এক প্রবীণ ব্যক্তি। আর প্রযুক্তির সুবিধাকে বাঁচিয়ে রাখতে যুক্ত করা হয়েছে সমাজের নিয়মকে। ‘আমরা এখন বুঝেছি, জল ঠিক ভাবে ব্যবহার করা কতটা জরুরি। তাই আমাদের এই পুকুরের জল ব্যবহারের জন্য একটা স্থানীয় জল কমিটি রয়েছে, যারা ঠিক করে কোন পরিবার কী ভাবে ক’দিন জল পাবে।’ যেখানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল, তার সামনেই একটি পুকুর, টইটম্বুর, মাছ-ভরা।

Advertisement

স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, শুধু এই ধারা বিকাশ-এর ফলেই, অন্তত শুখা অঞ্চলে, গত মে মাসের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধীদের পর্যুদস্ত করে দুই-তৃতীয়াংশ আসন জিতেছে পবন চামলিংয়ের এসডিএফ। বোঝা কঠিন নয়, চামলিং সরকার কেন আরও প্রায় সাড়ে ছশো ঝর্নাকে বাঁচিয়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছে। ইতিমধ্যেই দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলাতে স্থানীয় মডেল হিসেবে বেছেছে ধারা বিকাশকে।

যদিও পাহাড়ি সিকিম ও সমতল পশ্চিমবঙ্গের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান আলাদা, তবুও ঠিক এখানেই তুলনাটা আসছে পশ্চিমবঙ্গের ‘জল ধরো জল ভরো’ প্রকল্পের সঙ্গে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রথম ক্যাবিনেট মিটিংয়ে এই প্রকল্প ঘোষণা করায় পরিবেশবিদরা উৎসাহিত হয়েছিলেন। মনে হয়েছিল, এত দিনে একটা সরকার মাটির তলায় জল সংরক্ষণের মতো এমন একটা বিষয় নিয়ে পদক্ষেপ করল, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু যাতে হেডলাইন পাওয়া যায় না। কিন্তু যাবতীয় সদিচ্ছাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে প্রকল্প প্রয়োগের উদ্দেশ্যহীনতা। মুখ্যমন্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে আধিকারিকরা নাকি এই প্রকল্পের জলাধারের সংখ্যা লক্ষ্যমাত্রার চারগুণ উপরে নিয়ে গেছেন— সরকারের এক হাজার দিনের কাজের বিবরণীতে দেখা যাচ্ছে, পাঁচ বছরে পঞ্চাশ হাজার জলাধার কাটার লক্ষ্যমাত্রা ছিল, দু’বছরেই এক লক্ষের বেশি জলাধার কাটা হয়েছে! কিন্তু মাটি কেটে একশো দিনের প্রকল্পে টাকা পাইয়ে দেওয়ার বেশি কাজের কাজ বিশেষ হয়নি। সরকারি তথ্যই বলছে যে, মাটি তলার জলস্তর ক্রমশই নামছে।

‘এমন একটা চমৎকার প্রকল্প মার খাচ্ছে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে। দরকার ছিল বিজ্ঞানীদের সাহায্য নিয়ে কোথায় কতটা গভীর জলাধার কাটতে হবে তা ঠিক করা, যাতে জমা জল মাটির তলার জলস্তরে পৌঁছতে পারে। প্রয়োজন ছিল জলাধারে জল ঢোকা ও বেরনোর সুবন্দোবস্ত করা। কিন্তু যখন যেমন টাকা এসেছে, সেই অনুযায়ী কিছু মাটি কাটা ছাড়া বিশেষ কিছু হয়নি।’ পরিবেশ সংক্রান্ত এক আলোচনাসভায় বললেন এক জল-বিশেষজ্ঞ। আফসোস করলেন, ‘জানেন, এই প্রকল্পটা ঠিক মতো রূপায়ণ করলে গ্রামবাংলার ছবিটা পালটে যেত।’ পালটানো যে যায়, তার উদাহরণ পারবিং।

ঋণ: থার্ড পোল, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন