অন্য ‘প্রান্তিকতা’। ইউপিএসসি পরীক্ষার বিরুদ্ধে আন্দোলন। ইলাহাবাদ, ৭ অগস্ট। ছবি: পিটিআই
অখ্যাত অজ গাঁ বঙ্কা, উত্তরপ্রদেশের লখিমপুর জেলায়। বছর চারেক আগে জানা গেল, এই দলিত অধু্যষিত গ্রামটিতে একটি দলিত মন্দির তৈরি হচ্ছিল, যে দেবীর জন্য তাঁর নাম ‘গডেস ইংলিশ’! স্ট্যাচু অব লিবার্টি-র আদলে তৈরি এই ‘ইংলিশ’ প্রতিমার পরনে গাউন, মাথায় হ্যাট, এক হাতে কলম, অন্য হাতে ভারতীয় সংবিধান। কম্পিউটার মনিটর আকারের বেদির উপর অধিষ্ঠিত এই প্রতিমা। সমাজে সবচেয়ে অবদমিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী দলিতরা। আদি-পরিচয় নিয়ে তাদের তত আত্মাভিমান নেই, তাই তারা আধুনিক বিদ্যা, আধুনিক ভাষাকে হাতিয়ার করে উত্তরণের পথ খুঁজছে।
এই ইংরেজি-প্রীতির বিপরীতধর্মী অন্য এক সামাজিক অবস্থান আমরা সম্প্রতি দেখলাম ইউপিএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রতিবাদ পরিচালনায়। পরস্পর-বিরোধী দুই ধারা। হয়তো দুই ধারাই সমাজ-বিন্যাসের নতুন আঙ্গিক ও ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে ‘ঐতিহ্য’কে অতিক্রম করার সূত্র।
ইউপিএসসি প্রিলিমস পরীক্ষা দুই ভাগে বিভক্ত— জেনারেল স্টাডিজ ১ আর জেনারেল স্টাডিজ ২। দুশো নম্বর করে দুই পরীক্ষার দ্বিতীয়টির নাম CSAT বা সিভিল সার্ভিস অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট। আপত্তি আর বিতর্ক এই অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট বা সহজাত দক্ষতা নিরূপণের পরীক্ষাটি ঘিরেই। এরই প্রবল বিরোধিতা করছে সেই সব ছাত্রছাত্রী যারা নিজেদের হিন্দি মাধ্যমে শিক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের বাসিন্দা বলে নিজেদের এই পরীক্ষায় অপারগ বলে দাবি করছে। দাবি করছে যে এই পরীক্ষায় শহুরে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত ছাত্রছাত্রীরা এমনিতেই অনেকটা বেশি সুবিধা পাবে।
কী আছে এই CSAT বিভাগে? আছে যোগাযোগ দক্ষতা, যুক্তির বোধ, বিশ্লেষণের ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পারদর্শিতা, মৌলিক গণিত শাস্ত্রের শিক্ষা, ইংরেজি বোঝার পরীক্ষা বা কমপ্রিহেনশন। ২০১১ সাল থেকে চালু হয়েছে এই বিভাগ। এই নতুন ধাঁচের পরীক্ষার ফলেই নাকি পিছিয়ে পড়ছে হিন্দি বলয়ের কলাবিদ্যায় শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা। এই দাবি কতটা ঠিক সন্দেহ আছে, কেননা বেশ কিছু বছর ধরেই কিন্তু ইউপিএসসি-তে তুলনামূলকভাবে বেশি সফল হতে দেখা যায় ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি ও ম্যানেজমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের।
রাজধানী দিল্লিতে প্রতি বছর এসে জড়ো হয় হাজার হাজার ছেলেমেয়ে, দেশের নানা প্রান্ত থেকে। অধিকাংশের চোখেই ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন। এদের অনেকেই যখন এই আন্দোলনে যোগ দিল, প্রাথমিক ভাবে মনে করা হল, প্রতিবাদ আসলে CSAT প্রশ্নপত্রের ইংরেজি অংশের বিরুদ্ধে। সুতরাং, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত বা শহুরে ছেলেমেয়েরা অতিরিক্ত সুবিধাপ্রাপ্ত, এই দাবি আংশিক মেনে সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে, ইংরেজি পারদর্শিতার অংশটুকু মেধা-তালিকা গঠনে গ্রাহ্য হবে না। অথচ দেখা গেল, এতেও প্রতিবাদীদের দাবি মিটছে না। তারা চাইছে গোটা CSAT বাতিল হোক। অর্থাৎ? বকলমে স্বীকার করেই নেওয়া হল যে, হিন্দি মাধ্যম শিক্ষার ফলে সহজাত দক্ষতাতেই ঘাটতি থেকে যায়। এও এক ধরনের ‘বঞ্চনা’বোধের প্রতিফলন। এই ভাবেই তৈরি হচ্ছে আরও এক রকমের নতুন ‘বঞ্চনা পরিচিতি’, শিক্ষা-পরিচিতির অনুষঙ্গে।
ভারতে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে তুলনামূলক বঞ্চনা-উদ্ভূত আন্দোলন বহু দিনের পুরনো। ন্যায্য অধিকারের আশা-আকাঙ্ক্ষা ফলপ্রসূ না হওয়া যেমন জন্ম দেয় আপেক্ষিক বঞ্চনাবোধের, ঠিক তেমনি সম্পদবিন্যাসে অপরের থেকে পিছিয়ে পড়ার বাস্তবতা গড়ে তোলে তুলনামূলক বঞ্চনার। এই দুই বঞ্চনার অক্ষে পরিচালিত গোষ্ঠীচেতনা-সমৃদ্ধ ভারতীয় সমাজে আমরা দেখি সরকারি আমলাতন্ত্রের কাঠামোয় সফল প্রতিনিধিত্ব একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মূলধন বলে গণ্য হয়। ব্যক্তি নয়, গোষ্ঠী-পরিচিতি এখানে সামাজিক সচলতা আর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইউপিএসসি পরীক্ষা নিয়ে আন্দোলনও এর সঙ্গেই যুক্ত।
লক্ষণীয়, গত দুই দশকে ধর্ম বা জাতপাত-ভিত্তিক রাজনীতি আস্তে আস্তে ছাত্র-যুব মননে অপ্রাসঙ্গিক হতে বসেছে। কারণ, সেই নব্বই দশকেরই বিনিয়ন্ত্রিত উদার অর্থনীতি তাদের এক ‘উদার’-স্বপ্নকল্পিত স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করেছে। বাজারধর্মী সংস্কার আর তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ ক্রমে ‘কেন্দ্রীয়’ ও ‘প্রান্তিক’, এই দ্বিমুখী বিভাজনকে অর্থহীন করে তুলেছে। ছোট শহর, বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল ‘প্রান্তিক’ হলেও, পরিষেবা ক্ষেত্রের প্রসার ও কৃষিজমির বাণিজ্যীকরণের ফলে অনেক পাল্টেছে সেই প্রান্তিকতা। সামাজিক বা বাচনিক দক্ষতায় তারা আর তত পিছিয়ে নেই।
শুধু রাজধানীতেই নয়, শহর-শহরতলির অলিতে-গলিতে এখন বিবিধ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। স্পোকেন ইংলিশ, ব্যবহারিক/ফলিত বিদ্যাচর্চা, কম্পিউটার শিক্ষা। এর পাশেই আবার ইউপিএসসি-র মাধ্যমে আমলাতন্ত্রে যোগদানের অমোঘ আকর্ষণ। স্বপ্নতাড়িত ছাত্র-যুবসমাজ নিজেকে আরও উন্নত করতে চায়। টিভি চ্যানেলে এরাই আজ দৃশ্যমান। দুর্নীতিবিরোধিতার মঞ্চেও। সাম্প্রতিক সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে অনেক বেশি দৃশ্যগোচর হিন্দ বলয়ের, হিন্দি ভাষা-নির্ভর যুবসমাজের জোরালো অংশগ্রহণ, যার আর এক নাম আম আদমি। কেজরিওয়াল-উদ্দীপিত বিকাশমুখী, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে আর ‘আচ্ছে দিন’-এর বিকাশ প্রকল্পেও সম্ভবত এই ছাত্র-যুবসমাজই শামিল।
এই আন্দোলন ও নির্বাচনী প্রচারে কিন্তু ভেদাভেদির স্বর এখন অনেকটাই পিছনের সারিতে। সেই প্রেক্ষিতে, সরকারি প্রশাসনিক কাজকর্মে হিন্দি ভাষা ব্যবহারের ফরমান আর পাশাপাশি ইউ পি এস সি পরীক্ষার্থীদের হিন্দি-মুখী আস্ফালন ঠিক কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? এ-ও কি এক বিপজ্জনক সমসত্ত্বমূলক ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ প্রকল্প? বলা মুশকিল। বিদ্বেষ-রাজনীতি নিশ্চয়ই বিক্ষিপ্ত ভাবে রয়েছে, তবে প্রধানত এই আন্দোলন শহুরে ও সর্বজনীন, সকলকে নিয়ে চলার হিসেবটাই চোখে পড়ে।
আর একটা বিষয় লক্ষণীয়। পরীক্ষার ইংরেজি অংশ মেধা-তালিকায় বিবেচ্য হবে না, সরকারের এই সিদ্ধান্তেও বিরোধিতা কিন্তু থেমে যায়নি। উঠেছে গোটা CSAT বা Aptitude Test-কেই বাতিল ঘোষণার দাবি। কেন? কেননা, এই ধরনের পরীক্ষা কমন এনট্র্যান্স টেস্ট (CAT) অনুকরণে পরিকল্পিত। প্রশ্ন উঠেছে, ইউপিএসসি কেন ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা যাচাই করবে? আমলাতান্ত্রিক দক্ষতার মানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলার ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা আছে কি না, কতটা আছে, সেটা যাচাই করাই ইউপিএসসি-র লক্ষ্য হওয়া উচিত। পরীক্ষায় বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত Humanities-ভিত্তিক প্রশ্নের। পরিচালনার দক্ষতা আর আমলাতান্ত্রিক দক্ষতা তো এক নয়। যুক্তিটা ভালই। তবে, পরীক্ষার্থীই পরীক্ষার বিষয় নির্দিষ্ট করে দিতে পারে কি না, সেটা আলাদা প্রশ্ন!
দেশের সমাজ-অর্থনীতির গতিমুখ কি এই প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? গত দশকেই স্পষ্ট, বিশ্বায়িত পৃথিবীতে জ্ঞান-ভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজের আদর্শই ভারতের ভবিষ্যৎ। শিক্ষা, গবেষণায় উদ্ভাবন, মেধাস্বত্ব সুরক্ষা, শিল্প-কৃষিতে ব্যবহারিক জ্ঞানের বৃদ্ধি, সরকারি পরিচালনা ব্যবস্থায় দক্ষতা বৃদ্ধি: জ্ঞান-ভিত্তিক (Knowledge-based) পরিকাঠামোর সাহায্যেই এ সব নিশ্চিত করা সম্ভব। কেন্দ্রীয় নিয়োগ সংস্থা ভাবতেই পারে, বিগত দিনের আমলাতন্ত্রের দর্শন অচল এই নতুন সময়ে। আধুনিক আমলাতন্ত্রের জ্ঞানভিত্তি হবে ভিন্ন, প্রয়োগ-কৌশলও হবে ভিন্ন। আমলার কাজ কেবল কর্তৃত্বগিরি নয়, তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর রূপায়ণও তাকে করতে হবে। বিগত সরকারের নীল নকশায় এই সব কিছুই ছিল। বর্তমান সরকার হয়তো তাকে আরও এগিয়ে নিতে চায়। ‘মানবিক’ দর্শনপুষ্ট সমাজ-পরিচালনায় ক্লান্ত দেশ হয়তো এ বার চাইছে তথ্য-সিদ্ধ বিদ্যার প্রয়োগ আর তার অর্থপূর্ণ রূপায়ণ।
দিল্লির শ্রীবেঙ্কটেশ্বর কলেজে সমাজবিদ্যার শিক্ষক