প্রবন্ধ ১

এই উৎসব হোক বৃহৎ বাঙালির

বাংলা নববর্ষে জড়িয়ে যাচ্ছে জাতিপরিচয়ের সুতীব্র অহংকার। একটি বিশেষ ভাষার মানুষের জাতীয় সংস্কৃতি বলে যাকে দাবি করছি, তা হল অনেক মানুষের, একাধিক জাতির মানুষের। মৃন্ময় প্রামাণিকচৈত্র সেল, শিবের গাজন, চড়ক পুজো, ধর্ম পুজো, নীলের উপোস কয়েক দিনের মধ্যে শেষ করতে করতেই পয়লা বৈশাখ। নতুন জামা, সকাল সকাল স্নান, রবীন্দ্রসংগীত, পাড়ার ক্লাবে, অ্যাপার্টমেন্টে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আরও এক বার বাঙালির নামে জয়জয়কার, নিজেদের আবিষ্কার, গদগদ হয়ে ওঠা, কে কত বড় বাঙালি, গভীর বাঙালি ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করা। কিন্তু বাঙালি হয়ে ওঠার শর্ত কী? বাংলা ভাষা জানা বা জন্মসূত্রে বাংলা ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ থাকা, এই তো জনপ্রিয় চিন্তায় আমরা ধরে থাকি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩০
Share:

ও পার বাংলায়। নববর্ষ উৎসব, ঢাকা। ছবি: এএফপি।

চৈত্র সেল, শিবের গাজন, চড়ক পুজো, ধর্ম পুজো, নীলের উপোস কয়েক দিনের মধ্যে শেষ করতে করতেই পয়লা বৈশাখ। নতুন জামা, সকাল সকাল স্নান, রবীন্দ্রসংগীত, পাড়ার ক্লাবে, অ্যাপার্টমেন্টে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আরও এক বার বাঙালির নামে জয়জয়কার, নিজেদের আবিষ্কার, গদগদ হয়ে ওঠা, কে কত বড় বাঙালি, গভীর বাঙালি ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করা। কিন্তু বাঙালি হয়ে ওঠার শর্ত কী? বাংলা ভাষা জানা বা জন্মসূত্রে বাংলা ভাষার সঙ্গে যোগাযোগ থাকা, এই তো জনপ্রিয় চিন্তায় আমরা ধরে থাকি।

Advertisement

কিন্তু সত্যি কি বাঙালি আর বাংলা এক? বাঙালি দিয়ে যদি খুব আপাতভাবে আমরা বাংলাভাষী মানুষদের বুঝিয়ে থাকি, তা হলে বাংলা দিয়ে তো একটি বৃহত্তর ভূখণ্ডকে বোঝানো হয়। নিজের কোনও উৎসব বা অনুষ্ঠান উদ্যাপনে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সেটা যদি নিজেকে প্রতিবেশীর কাছে থেকে দূরে করে বা পরকে আরও বেশি পর করে, তা হলে অবশ্যই সে উদ্যাপনের গঠন নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। পয়লা বৈশাখের ভাঁজ-ভাঙা নতুন জামা যদি পাশের সাঁওতাল পাড়ার লোকজনের কাছে আমাকে বেশি ‘বাবু’ করে তোলে, তা হলে তার সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধন ক্রমশ ছিন্ন হবে। তার সামনে সাংস্কৃতিক সংকেত দিয়ে নিজের অজান্তেই আমি আমার ক্ষমতা জাহির করে ফেলব। এই ক্ষমতা জাহির করা থেকে দূরত্ব, তা থেকে উচ্চ-নীচ ইত্যাদি নানা চিন্তা, সেখান থেকে বিরোধ, প্রতিরোধ।

কেবলমাত্র প্রতিরোধের ভয়েই কি পয়লা বৈশাখের মতো দিনকে ইনক্লুসিভ ভাবে উদযাপন করতে হবে? না, তা নয়। আমাদের দেখতে হবে সাংস্কৃতিক অবিমিশ্রতা ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারের প্রশ্নটিও। বাংলা বা ভারতের ভূখণ্ডে যেখানে যেখানে বাঙালি আছে, বেশ দাপটের সঙ্গেই আছে বহুদিন ধরে, একেবারে যদি অভিবাসী শ্রমিকদের কথা ছেড়েই দিই। তা হলে একটি সুযোগভোগী জাতি হিসেবে বাংলার বৃহত্তর ভূখণ্ডে যখন এমন কিছু অনুষ্ঠান বা দিন উদযাপন করা হচ্ছে, যা ওই ভূখণ্ড বা ওই ভূখণ্ডের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের পরিচয় নির্মাণ করে, তখন উচিত প্রান্তিক ইতিহাসের হাত ধরে চলা। কিন্তু শুধু প্রান্তিক ইতিহাস কেন? কলকাতা তো কসমোপলিটান। সেখানে বহু ভাষাভাষীর মানুষের বাস, তা হলে? কারণ, ভাষা-ভিত্তিক প্রদেশের যে মানুষজন কলকাতায় আছেন, তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিত্ব ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু প্রান্তজনের রাষ্ট্রচিন্তা বাংলার ভূখণ্ডের বাইরে প্রসারিত নয়। যে লেপচা বা রাজবংশী বাংলায় থাকে তার সমান অধিকার সেই ভূখণ্ডে, কিন্তু তাকে অনেক আপস করে নিতে হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দাবি, অধিকার ও আগ্রাসনের সঙ্গে। কিন্তু পয়লা বৈশাখে প্রান্তজনের হাত ধরে চলা ব্যাপারটা কেমন?

Advertisement

সরকারি সমস্ত কাজকর্ম চলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে। পয়লা বৈশাখ তাই নিছক একটি বাঙালিয়ানাকে ধরে রাখা। ‘বাঙালি’ শব্দটাকে যদি প্রসারিত ভূখণ্ডের আঙ্গিকে ধরি, তা হলে অন্তত একটি দিন বৃহত্তর সমাজের কাছে জাতি কুল মান নির্বিশেষে একই পঙ্ক্তিতে বসার সুযোগ করে দেয়। পয়লা বৈশাখে যেন আমরা ১লা না থাকি। শুরুটা যদি বৈচিত্রময় সংস্কৃতির হাত ধরে হয়, তা হলে অন্তত সেই বার্তাটাকে আমরা সারা বছর নানা সমস্যার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করব। প্রান্ত আর কেন্দ্রের ব্যবধান কমানোর এটা একটা প্রয়াস। এই দিনটা বাংলার হিসেবে ঘোষিত হোক, শুধু ক্ষুদ্র বাঙালির না হয়ে। এই দিনটা ছাড়া আমাদের আর উপায় নেই। দুর্গাপুজো বা ঈদ, বড়দিনের মতো কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান দিয়ে সেটা সম্ভব নয়।

বাংলার ভূগোলের গ্রামীণ বা লোকসংস্কৃতি যদি আমরা দেখি, তা হলে দেখব, বিভিন্ন রেস বা জাতির মানুষ মিশে গেছে সেই সংস্কৃতির ধারায়। বহু দিন ধরে একসঙ্গে বাস করা আমাদের অন্তর্লীন করে দেয় একাধিক কমন সংস্কৃতির সঙ্গে, প্রতিবেশী হয়ে ওঠে পরস্পরের যুগল। গাজন, চড়ক, ঝুমুর, ভাদু, টুসু, ধর্মঠাকুর বা নীলের পুজো কেবলমাত্র বাঙালির নয়। সেখানে সাধারণ প্রান্তবাসী মানুষের শ্রেণি-পরিচয় ও শ্রেণি-চেতনা নিজেদের একত্রিত করেছে জাতি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে গিয়ে। তাই রেস তাদের কাছে বড় নয়, বড় তাদের কাছে ক্লাস। এক জন অন্য জনের মধ্যে নিজের অনুরূপকে অনুসন্ধান করে খুঁজে পেলেই সে মিশে যেতে পারে তার সঙ্গে সহজে। সাঁওতাল, ওরাওঁ বা মুন্ডার কাছে ধর্ম বা নীল ঠাকুর হিন্দু ধর্মের কোনও আবেদন বা অধিকার রাখে না। সেই দেবতা হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের, প্রান্তজনের। সেখানে বাংলাভাষী হিন্দু ও অন্যভাষী মানুষ ধর্মীয় ভাবে দূরত্ব কাটিয়ে ওঠে। এইখানেই বৃহত্তর ভাবে সংস্কৃতিতে মানুষের অন্তর্ভুক্তি ঘটে। এখানে অনেকের মনে হতে পারে যে, ধর্মকে পয়লা বৈশাখের সংস্কৃতির প্রাক্ভূমি হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে তো পান্তাভাত আর ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয়। সে ক্ষেত্রে দুটো বিষয় উঠে আসে। এক, ধর্ম নিজে সংস্কৃতির অঙ্গ এবং কোন ধরনের ধর্মের কথা বলা হচ্ছে তা দেখতে হবে, হালখাতার সিদ্ধিদাতা গণেশ পুজোর সীমিত পরিসরের ধর্ম, নাকি বড় কিছু, অন্য রকম কিছু। আর দুই, ধর্মীয় চিহ্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষের বেঁচে থাকার ও ‘আপন’ কল্পনার সাংস্কৃতিক অভ্যেস হয়ে উঠেছে কি না, এ বিষয়টি এ ক্ষেত্রে পরীক্ষণীয়। এই প্রবন্ধে দ্বিতীয়টির দাবি মুখ্য।

ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের মধ্যে রয়েছে একটি বছরের জন্মদিনকে উদ্যাপন করা, কিন্তু বাংলা নতুন বছরে কেবল একটি নতুন বছরের জন্মদিনকে উদ্যাপন না, তার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে জাতিপরিচয়ের সুতীব্র অহংকার। সমস্যা সেখানেই। একটি বিশেষ ভাষার মানুষের জাতীয় সংস্কৃতি বলে আমরা যাকে দাবি করছি, তা হল আসলে একসঙ্গে অনেক মানুষের, একাধিক জাতির মানুষের। আর সামাজিক বিবর্তনের মাধ্যমে যুগে যুগে তা তৈরি হয়েছে, জাতিনির্বিশেষে মানুষে মানুষে প্রয়োজনীয়তা থেকে ভালবাসা থেকে তা তৈরি হয়েছে। সমাজের প্রান্তে যখন মানুষ ও সংস্কৃতি একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে আদানপ্রদান বাড়িয়ে তুলছে ক্রমশ, তখন একটা কিছুকে তীব্র বাঙালিয়ানার চিহ্ন বলে দাবি করার মধ্যে বাঙালির জাতি-কল্পনা দৃঢ় হয় বটে, কিন্তু সেখানে সাংস্কৃতিক নির্বাচনের পদ্ধতি হয়ে ওঠে অবৈজ্ঞানিক। কারণ, যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাঙালি জাতির পরিচয় ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, সেই ভিত্তিভূমিই মিশ্র, বহু, বিবিধ, বিচিত্র।

পয়লা বৈশাখ ঐতিহাসিক কারণেও একটি বিশেষ ভূখণ্ডে ইনক্লুসিভ হওয়ার দাবি রাখে। পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের ইতিহাস তৈরি মুঘল সম্রাট আকবরের সময় থেকে, যখন তিনি বাংলায় কৃষি কর আদায়ের সুবিধার জন্য হিজরি ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসারে কর আদায় শুরু করেন ও নির্দেশ দেন চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব কর পরিশোধের জন্য। বাংলা ভূখণ্ডের মানুষ সে দিন থেকে পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু করে এবং সেখানে বাঙালির সঙ্গে সঙ্গে ছিল সমান ভাবে আদিবাসী কৃষকসমাজ। পয়লা বৈশাখ উদযাপনের পিছনে তাই রয়ে গেছে একটি ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক কারণ। এই কারণগুলো কমন ধরে নিলে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের ক্ষেত্রটিকে ইনক্লুসিভ না করার কোনও যুক্তি থাকে না।

এ পার বাংলায় পয়লা বৈশাখ উদযাপনে যে-ভাবে বাণিজ্যিক সম্ভোগ রয়েছে, ওপার বাংলায় সেই ভাবে রয়েছে সাংস্কৃতিক উপভোগ। অন্তত গুগল ইমেজে পয়লা বৈশাখের ছবি অনুসন্ধান করতে গেলে সেই বিষয়টায় চোখে পড়ে। কিন্তু এই দুই পারের মধ্যে বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার জন্ম একটি বড় ক্রাইসিস থেকে, সেই প্রেক্ষিত মাথায় রাখলে সেই দেশের নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা ও সে দিক থেকে জাতীয় সংস্কৃতি বলে কিছু উপস্থাপন করা বেশ প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই দেশও তার জাতীয় সংস্কৃতি উদযাপনে যদি মুক্তমনা না হয় ও মুক্ত অঙ্গন নির্মাণ না করে, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে আদিবাসিন্দাদের দিক থেকে সাংস্কৃতিক বিরোধ আসতেই পারে। যেহেতু সেই দেশে নিশ্চিত ভাবেই পয়লা বৈশাখের মতো অনুষ্ঠান জাতীয়তাবাদের ধারণার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের অনুসরণে কলকাতাতেও আয়োজিত হতে চলেছে একটি বইমেলা, কলেজ স্কোয়ারে। যেখানে মানুষের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছে দেওয়া হবে বাংলা বই এবং মানুষকে উৎসাহিত করা হবে বাংলা বইপাঠে। এই উদ্যম নিশ্চয়ই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু এই উৎসব আরও বেশি করে প্রকট করে পয়লা বৈশাখের বিস্তৃত সাংস্কৃতিক চিহ্নকে। পয়লা বৈশাখের স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে যায় আরও একটি ইমেজ। এবং আমাদের জাতি কল্পনা আরও মজবুত হয়। এর সঙ্গে চলে আসে রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক চিন্তা। আর বোধ হয় এখানেই সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন, সচেতন হওয়া প্রয়োজন। উত্তরবঙ্গের নেপালি, লেপচা থেকে শুরু করে দক্ষিণ ও পশ্চিমের সাঁওতালি, শবর, পাঞ্চপরগনিয়া ইত্যাদি ভাষার সাহিত্য ও সাহিত্যিকদেরও মঞ্চ মিলুক। চ্যানেলে চ্যানেলে তাঁরাও আমন্ত্রিত হয়ে উঠুন। একটা কথা তো মনে রাখতেই হবে, প্রায় একই রকম ক্যালেন্ডারের গড়ন নেপালি থেকে শুরু করে সাঁওতালি সবাই অনুসরণ করে। বাংলার ভূগোলে নতুন বছর সব জাতিরই একই সঙ্গে শুরু হয়।

লেখক হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও অনুবাদ চর্চার গবেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement