প্রবন্ধ ২

একটু ভয়ই দেখাও মা

এমন একটা সময় এসেছে রাজ্যে, যে মনে হয়, এই অনাচার দমনের জন্য নৃমুণ্ডমালিনী ছাড়া গতি নেই। লিখছেন চিরশ্রী মজুমদার। অথচ, সে ভয় মোটেও ডাকিনী-প্রেতিনী-জম্বিদের নয়। বয়স তখন সাত কি আট। কলকাতায় বিজয়া দশমী ফুরোলে টুনি বাল্ব, পাইপ লাইট খুবলিয়ে কারা যেন হঠাত্‌ কয়েক পোঁচ অন্ধকার ছুড়ে দিয়ে যেত শহরটার চোখে। প্যান্ডেল-ব্যানার উপড়ে অকস্মাত্‌ খণ্ডহর রাস্তাঘাট। এ দিকে সে দিকে ক্রমে রক্তঝরা মুণ্ডমালা, খড়ের বিশাল বিশাল দাপুটে পা, তার নীচে শোওয়া ভোলেবাবা, হাতে ধারালো খাঁড়া।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share:

অথচ, সে ভয় মোটেও ডাকিনী-প্রেতিনী-জম্বিদের নয়। বয়স তখন সাত কি আট। কলকাতায় বিজয়া দশমী ফুরোলে টুনি বাল্ব, পাইপ লাইট খুবলিয়ে কারা যেন হঠাত্‌ কয়েক পোঁচ অন্ধকার ছুড়ে দিয়ে যেত শহরটার চোখে। প্যান্ডেল-ব্যানার উপড়ে অকস্মাত্‌ খণ্ডহর রাস্তাঘাট। এ দিকে সে দিকে ক্রমে রক্তঝরা মুণ্ডমালা, খড়ের বিশাল বিশাল দাপুটে পা, তার নীচে শোওয়া ভোলেবাবা, হাতে ধারালো খাঁড়া।

Advertisement

কালীপুজো এগিয়ে এলেই হৃত্‌পিণ্ড দলা পাকিয়ে যেত। মা কালী আসা মানেই অন্তরীক্ষে স্কুল শুরুর ঘণ্টা। এক মাস ছুটি মেপে কাজ দেওয়া হয়েছে একরাশ। আরে! দশ দিন তো উত্‌সবেই উবে গেল। বাকি দিন ক’টা ‘কাল থেকে পড়া’ সুরে ঢুলতে ঢুলতে দেখি প্যান্ডেল কমপ্লিট, নীল শরীর লাল হাত নিয়ে লেলিহান জিহ্বা মেলে দাঁড়িয়ে মা। অর্থাত্‌ স্কুল খুলতে দিন দু’-চার, শিয়রে পাহাড় সিলেবাস। ভূতের থেকেও খতরনাক।

কালীপুজোর দিনে আমার স্কুলের প্রতিষ্ঠা। স্কুলের মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট দিনে প্রেয়ারে বাজত শ্যামাসংগীত। ‘আমরা মায়ের মেয়ে সবাই মিলে মাকে পূজিব’, মধুর গানটি আমাদের কাছে বেদনাবিধুর! হাফ-ইয়ার্লি, অ্যানুয়াল, উইকলি টেস্ট, রেজাল্ট-এর ডি-ডে’টি এলে এই গানই গাইতে হয়। অন্য দিনে কেউ গেয়ে ফেললে বা কোথা থেকে দু-এক কলি কানে এলে, বিজবিজ করে ঘাম ছুটত কপালে। আজ কে বলি যাবে রে!

Advertisement

বলির ভয় কি সাধে? এক বার, মা কী মনে করে সব বইখাতায় দেবদেবীর ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার দিয়ে মলাট দিলেন। অঙ্ক বইয়ে শান্ত-নির্মল ভবতারিণী। তাতে কী যে রক্ত-ছিটে লাগল, সারা বছর কোনও আঁকই মগজে ঢুকতে পেল না। খাতা ভরতি লাল দাগ, কঠিন রিমার্ক, শেষমেশ কোনও ক্রমে ১০০-য় ৬৭!

আর এক বছর। আমার কাঁধে ফিনফিনে পাখনা গজিয়েছে, স্কুলে আসতে কোচিংয়ে যেতে শুতে খেতে মুখে ফটরফটর হিন্দিগানের কলি। এক সোমবারে পণ করলাম আজ থেকে স্কুলের ওই বজ্রকঠিন নিয়মনীতির সামনে মাথা নোয়াব না। মূর্তিমতী অবাধ্যতা হয়ে হুমহুম গান ভাঁজতে ভাঁজতে ক্লাসে ঢুকলাম। কেউ শোনেনি, তাই শাস্তিও আসেনি, কিন্তু অদৃষ্ট বাদ সাধল। ফার্স্ট থেকে লাস্ট পিরিয়ড শুধু ভুল, সুতরাং অপমান। স্কুল থেকে বেরিয়ে মা কালীর মতোই জিভ কাটলাম— জীবনে কখনও আর এমন হবে না। অথচ যে গান গেয়ে কপাল ফাটল, সেটা হিট হিন্দি সিনেমার মশলাদার কালীবন্দনা!

অবুঝ বিশ্বাস আর সাংঘাতিক সব ভয়ের কাহিনি এখন স্মৃতির অনেক নীচে ঘুমোচ্ছে। তবে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষ ঠিকই আসে। ট্র্যাফিক সিগনালে গান বাজে, ‘কালো? তা সে যতই কালো হোক...’ আমিও বুঝতে পারি, আঁধার-চাপা দমবন্ধ শৈশবেও কতখানি সোনালি রং ছিল। মুণ্ডমালিনী আমাকে শুধু ত্রাসে মারেননি, অনেক আশীর্বাদও বিলিয়েছেন। এই যে সময়ের আগে যে কোনও কাজ শেষ করে ফেলার তাড়া, সে তো সেই পুজোর ছুটির সময়কার ‘কালীপুজো এসে গেছে’ আতঙ্কেরই মিঠে ফল।

আসলে সেই ভয়গুলোকেই আজ বড্ড মিস করি। এমন একটা বেচাল-বাচাল সময় এসেছে এখন, এমন এক অনন্ত উত্‌কট প্রহসনের রাজ্যে বসে রয়েছি যে, এত ফুর্তি আর রোশনাইয়ের মাঝে মাঝে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে মরি এক নিদারুণ অন্ধকারকে। এখানে পঠনপাঠনের পীঠস্থানে ছাত্র-শিক্ষক হাতা গুটিয়ে পরস্পরকে শাসায়। যত্রতত্র কোটি কোটি টাকা ওড়ে। ওপরতলা থেকে নীচতলা সেই অর্থ আত্মসাত্‌ করার জন্য দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতায় নামে। সমাজপ্রভুর দল আস্তাকুঁড়ের ভাষা বলে, আর নির্বাক-নির্বোধসম দেখে ও শোনে গাছ-পালা-মানুষ ও ছাগল। যা খুশি তাই-এর এই দেশ জোড়া অনাচারকে দমন করার জন্য দরকার এক কালদণ্ডের। মা কালীর দাপটের, তাঁর তাণ্ডব-হুংকারের। প্রয়োজন নিয়তির ভয়কে। আজ তাই আমার জীবন থেকে এবং এই রাজ্য থেকে বিদায় নেওয়া ভয়কে মনে মনে বলি: এক বার, জাস্ট এক বার। অনেক তো হল চিত্‌কার-উল্লাস-বিশৃঙ্খলা-হট্টগোল। এ বার চরাচর জুড়ে নামুক শিরশিরে হাড়হিম ভয়। সেই রাত্রি ফিরলে, সত্যিকারের দীপাবলি হয়তো আর বেশি দূরে থাকবে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন