গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং যখন তাঁহার প্রথম কোরীয় উপদ্বীপ সফরে উত্তর কোরিয়ায় না গিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল-এ পদার্পণ করিতে মনস্থ করিলেন, তখনই জল্পনা শুরু হয়, চিন বোধ করি পিয়ংইয়ংকে আর পূর্ববত্ সুনজরে দেখিতেছে না। বিশেষত প্রেসিডেন্ট কিম জং-আন-এর নেতৃত্বে উত্তর কোরিয়া তাহার ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু মারণাস্ত্র কর্মসূচিতে অটল থাকায় বেজিং হয়তো নিজের বিরক্তি এই ভাবেই ব্যক্ত করিতে চাহিতেছে। জল্পনাটি একেবারে অবাস্তব, তাহা বলা যাইবে না। উত্তর কোরিয়ার উপর চিন যথার্থই ক্ষুব্ধ। ওই হতদরিদ্র, কমিউনিস্ট শাসিত দেশটিকে চিনই খাবারদাবার ও অন্যান্য রসদ সরবরাহ করিয়া থাকে। বিশ্বে একঘরে হইয়া পড়া পিয়ংইয়ং চিনের সহায়তা ব্যতীত অস্তিত্বরক্ষা করিতেই অক্ষম। অথচ চিনা নিষেধ অমান্য করিয়াই সে পরমাণু মারণাস্ত্র বানাইয়া চলিয়াছে। বেজিংয়ের বিরক্তি অতএব সঙ্গত।
কিন্তু তাহাই যে চিনা প্রেসিডেন্টের সোল সফরের একমাত্র কারণ নয়, গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে চিন ও কোরিয়ায় ‘জাপানি উপনিবেশবাদীদের বর্বর আগ্রাসন’-এর তীব্র নিন্দা করিয়া তিনি যে ভাষণ দিলেন, তাহাতে স্পষ্ট হইয়া গেল। জাপানি সাম্রাজ্যবাদের সেই আগ্রাসনে চিনা ও কোরীয় জনসাধারণের অবর্ণনীয় যৌথ দুর্দশা ও যন্ত্রণার কথা তিনি তুলিয়া ধরেন এবং আগামী বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের ৭০ বছর পূর্তি যৌথ ভাবে উদ্যাপনের প্রস্তাবও দেন। চিনের তরফে হঠাত্ এই ভাবে পুরানো কাসুন্দি ঘাঁটিবার আবশ্যকতাও স্পষ্ট হয় উত্তর চিন সাগরে অবস্থিত কয়েকটি জনশূন্য দ্বীপের দখল লইয়া জাপানের সহিত তাহার কাজিয়া ও দাবির লড়াই মনে রাখিলে। সত্য, দক্ষিণ কোরিয়ার সহিত চিনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উত্তরোত্তর বর্ধমান। কোরীয় প্রেসিডেন্ট তাঁহার ভাষণে সেই সহযোগিতা বৃদ্ধির উপরেই বেশি জোর দেন। কিন্তু চিনা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য এবং সফর, উভয়েরই লক্ষ্য ছিল জাপানকে আঘাত করা। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উত্তর ও পূর্ব চিন সাগরে চিনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে জাপান, ফিলিপাইন্স, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশের প্রতিবাদকে দৃঢ় ভাবে সমর্থন করায় চিন দক্ষিণ কোরিয়াকে নিজের পক্ষে টানিয়া তাহার বিরুদ্ধে জায়মান সম্ভাব্য কূটনৈতিক জোটকে দুর্বল করিয়া দিতে বদ্ধপরিকর।
তবে কূটনীতি বড় বিচিত্র। চিনা প্রেসিডেন্ট যখন সোল সফরে গিয়া একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়া ও জাপানকে দুই ধরনের বার্তা দিতে উদ্গ্রীব, ঠিক তখনই জাপান এবং উত্তর কোরিয়াও গত ছয় দশকের পারস্পরিক অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিদ্বেষ দূরে সরাইয়া একে অন্যের কাছাকাছি আসিতে চেষ্টিত। হয়তো উত্তর-পূর্ব এশিয়ায় নিজের কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতা ঘুচাইতেই পিয়ংইয়ং গত আশি-নব্বইয়ের দশকে তাহার গুপ্তচরদের দ্বারা অপহৃত জাপানিদের তত্ত্বতালাশ করিতে একটি কমিশন গড়ার কথা ঘোষণা করে। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই জাপানি প্রধানমন্ত্রী উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা রদ করেন। এই সব নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্রপুঞ্জের পরামর্শক্রমেই। কিন্তু জাপানও পাল্টা দাবার চালে উত্তর কোরিয়াকে স্বপক্ষে টানিতে চায়। উত্তর কোরিয়ার বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে চাঙা করিতে যাবতীয় সহায়তা দিবার জাপানি আশ্বাস পিয়ংইয়ংকেও চিনের উপর নির্ভরতা কমাইতে সাহায্য করিতে পারে। আবার চিনের উপর নির্ভরশীল এবং চিনের অনুগত ও বশংবদ একটি রাষ্ট্রকে দল ভাঙাইয়া নিজের পক্ষে টানিতে পারিলে আঞ্চলিক কূটনীতিতেও জাপানের পক্ষে সুবিধা।