সম্পাদকীয় ১...

কালো গরুর দুধ

শাসনের মোহ অতি প্রবল। অনেক অভিভাবকই সন্তানের চরিত্র সংশোধনের সাধু অভিপ্রায়ে অতিশাসনের ফেরে পড়িয়া যান, তাহাতে সন্তানের স্বাভাবিক পরিণতি ব্যাহত হয়, চরিত্রের যথার্থ শুদ্ধিও হয় না। নির্বাচন কমিশনও কি সেই একই তাগিদের বশীভূত হইয়া সংযমের সীমা লঙ্ঘন করিতেছে? মুক্ত এবং অবাধ নির্বাচন পরিচালনায় কমিশন যে ভূমিকা পালন করিয়া আসিতেছে, যে ভাবে বিভিন্ন ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর অন্যায় প্রতিরোধে তৎপর থাকিয়া সেই অন্যায় প্রশমিত করিয়াছে, তাহা অবশ্যই ভারতীয় গণতন্ত্রের গর্বের বিষয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৪ ০০:১৫
Share:

শাসনের মোহ অতি প্রবল। অনেক অভিভাবকই সন্তানের চরিত্র সংশোধনের সাধু অভিপ্রায়ে অতিশাসনের ফেরে পড়িয়া যান, তাহাতে সন্তানের স্বাভাবিক পরিণতি ব্যাহত হয়, চরিত্রের যথার্থ শুদ্ধিও হয় না। নির্বাচন কমিশনও কি সেই একই তাগিদের বশীভূত হইয়া সংযমের সীমা লঙ্ঘন করিতেছে? মুক্ত এবং অবাধ নির্বাচন পরিচালনায় কমিশন যে ভূমিকা পালন করিয়া আসিতেছে, যে ভাবে বিভিন্ন ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর অন্যায় প্রতিরোধে তৎপর থাকিয়া সেই অন্যায় প্রশমিত করিয়াছে, তাহা অবশ্যই ভারতীয় গণতন্ত্রের গর্বের বিষয়। কিন্তু ক্রমশ একাধিক বিষয়ে কমিশনের নির্দেশিকা হয়তো স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণের সীমা অতিক্রম করিয়া অস্বাভাবিক নিষেধের বাড়াবাড়িতে পর্যবসিত হইতেছে। উদার গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই বিষয়ে সতর্কতা জরুরি।

Advertisement

সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন একটি নির্দেশিকা জারি করিয়াছে যে, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইস্তাহার রচনার সময় কিছু কিছু শর্ত মানিয়া চলিতে হইবে। নির্বাচনী আচরণবিধির বিভিন্ন দিক রহিয়াছে, এত দিন ইস্তাহার রচনা লইয়া কোনও স্বতন্ত্র নির্দেশিকা ছিল না, এ বার দশপ্রহরণধারী নির্বাচন কমিশন আর একটি প্রহরণ সংগ্রহ করিল। এই নির্দেশিকার মূল লক্ষ্য: ইস্তাহারে রাজনৈতিক দল যেন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়া নাগরিকদের সহিত প্রতারণা না করে। উদ্দেশ্য মহৎ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অবাস্তবতা বহুচর্চিত। কালো গরুর দুধ এবং দুধ খাইবার বাটি হইতে শুরু করিয়া যত প্রতিশ্রুতি আজ অবধি ভোটাররা শুনিয়াছেন, তাহার দশ শতাংশ পূরণ করা হইলেও কাহারও কোনও অভাব আর থাকিত না। যে কোনও নির্বাচনের মরসুমে যে কোনও দলের ইস্তাহার পাঠ করিলে যুগপৎ প্রবল কৌতুক এবং তীব্র বিরাগের সহিত মনে হওয়া স্বাভাবিক প্রবঞ্চনারও সীমা আছে! কিন্তু সেই প্রবঞ্চনা ভোটদাতারা আপন অভিজ্ঞতা হইতে দিব্য বুঝিয়া লইতে সক্ষম। ১৯৫২ সাল হইতে ছয় দশকের অধিক সময় ধরিয়া তাঁহারা বিস্তর শুনিয়াছেন এবং দেখিয়াছেন, বহু বার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের বহু সুযোগ পাইয়াছেন, তাঁহারা আজও মিথ্যা প্রতিশ্রুতিকে সত্য মনে করিয়া প্রতিশ্রুতিদাতার ঝুলিতে সরলচিত্তে ভোটদান করিয়া আসেন, এমন ভাবিলে তাঁহাদের প্রতি অবিচার হয়, ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তিকেও তাহার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। বস্তুত, মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করিয়া ঠকিবার ‘অধিকার’ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধর্ম। অনেকে হয়তো ঠকিয়াই শেখেন। তাহাও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

কমিশন স্বীকার করিতেছে, কোনও দল জনকল্যাণের দরাজ প্রতিশ্রুতি দিলে তাহাতে নীতিগত আপত্তির কিছু নাই, কারণ জনকল্যাণের অনুজ্ঞা সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতিমালাতেই দেওয়া আছে, রাজনৈতিক দল তাহা অনুসরণ করিতেই পারে। কিন্তু কমিশনের বক্তব্য, তেমন প্রতিশ্রুতি পূরণের আর্থিক সংস্থান কী ভাবে হইবে, ইস্তাহারে তাহার হদিশ দেওয়া জরুরি। বিচিত্র নির্দেশ। তবে কি নির্বাচনী ইস্তাহারের মধ্যে একটি বাজেটও পেশ করিতে হইবে? এহ বাহ্য। ইস্তাহার একটি দলের ইচ্ছাপত্র বিশেষ। ক্ষমতায় আসিলে সেই ইচ্ছাপত্র রূপায়ণের রসদ জোগাড় করার নৈতিক দায়িত্ব নিশ্চয়ই থাকে, কিন্তু তাহা একটি ‘মুক্ত’ দায়িত্ব, আগে হইতে তাহাকে জমাখরচের হিসাবে বাঁধিয়া দেওয়া চলে না। বস্তুত, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করিয়া জনপ্রিয়তা ধরিয়া রাখিবার এবং বাড়াইবার তাগিদে ক্ষমতাসীন দল অর্থ ও অন্যবিধ সামর্থ্য সংগ্রহের পথ খুঁজিবে, ইহাও গণতন্ত্রের একটি লক্ষণ। রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প, এই প্রাথমিক সত্যটি ভুলিলে চলিবে কেন? নির্বাচন কমিশন ভোটদাতাদের কাণ্ডজ্ঞানের উপর আস্থা রাখিতে পারেন, তঞ্চকতা তাঁহারা দিব্য ধরিয়া ফেলিবেন, ইস্তাহারের উপর সেন্সরের কাঁচি চালাইবার প্রয়োজন নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement