প্রবন্ধ ১

‘গীতা নামক গ্রন্থ’ কথাটাই অর্থহীন

গীতা নামে কোনও গ্রন্থ নেই, এমন নয়। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট মানে-যুক্ত টেক্সট হিসেবে ধরলে একাধিক গীতা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গীতার ব্যাখ্যাও। ভেবে দেখুন, ‘ভারতীয় ভাষা’ কথাটার কোনও নির্দিষ্ট অর্থ হয় কি?বিগত তিন হাজার বছরে ভারতীয় ভাষাগুলিতে যত বই রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি প্রভাবশালী সম্ভবত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, যদিও এটি মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি ছোট গ্রন্থাংশ। উপনিষদের ফার্সি অনুবাদের পাশাপাশি তাই সব উপনিষদের সার এই অনুপম গ্রন্থকেও অনুবাদ করেন শাহ্জাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকো।

Advertisement

অরিন্দম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

বিগত তিন হাজার বছরে ভারতীয় ভাষাগুলিতে যত বই রচিত হয়েছে তাদের মধ্যে সব থেকে বেশি প্রভাবশালী সম্ভবত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, যদিও এটি মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি ছোট গ্রন্থাংশ। উপনিষদের ফার্সি অনুবাদের পাশাপাশি তাই সব উপনিষদের সার এই অনুপম গ্রন্থকেও অনুবাদ করেন শাহ্জাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকো। বছর দুয়েক আগে একটি পত্রিকায় একটি মজার খবর বেরোয়, যার শিরোনাম ছিল: এ বার ডান দিক থেকে বাম দিকে গীতা পড়ুন। এস টি বেঙ্কট অপালাচারী উর্দুতে অনুবাদ করেছেন ভগবদ্গীতা। নাম দিয়েছেন ‘নাগ্মে ইলাহি’— ভগবানের সংগীত। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁর উর্দুর মৌলবিসাহেবকে, যিনি তাঁর কপালের তিন দাঁড়ির আয়েঙ্গার তিলক দেখে আদর করে তাঁকে ডাকতেন ‘একশো এগারো’ বলে।

Advertisement

কিন্তু হঠাৎ লালকেল্লার গীতা উৎসবে ক্ষমতার দুর্গে দাঁড়িয়ে যখন বিদেশমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, গীতাকে ‘জাতীয় গ্রন্থ’ বানানোর প্রস্তুতি চলছে, তখন শঙ্কা, কৌতুক ও ক্ষোভ হওয়ারই কথা, বিশেষত গীতাভক্তদের মনে। এ বার সত্যিই ‘রাইট’ থেকে শুরু করে গীতা পড়তে হবে, রাজনৈতিক অর্থে! স্বয়ংসেবকরা যাঁদের ঈর্ষা করেন, তাঁদেরই অনুকরণ করেন। নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থাকেই, কিন্তু তার উদ্দেশ্য নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি রক্ষা করা। জীবনাদর্শ, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং চিন্তার গতি বা বুদ্ধির পুরুষার্থ স্বাধীন ভাবে যুক্তির ভিত্তিতে নির্ণয় করা এমনই একটি অধিকার। একটি বিশেষ গ্রন্থকে ‘জাতীয়করণ’ করা শুধু সেই নাগরিক অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়, ‘সদুদ্দেশ্যে পিতৃসুলভ শাসন’, যাকে ‘পেটার্নালিজম’ বলে আধুনিক নীতিবিদ্যায়, সেই জাতীয় পরোক্ষ মগজধোলাইতুল্য কাজ।

কোনও বিষয়ে বিচারের সুযোগ দেওয়ার আগেই সার্বভৌম রাষ্ট্র নাগরিকদের চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করছে কি না, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার দরকার। ময়ূরকে ‘জাতীয় পাখি’ বললে একটি পাখিকে নিয়ে শিশুদের এক রকম গর্ব তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু তা থেকে অন্য পাখিদের প্রতি সমাদর, সম্মানের মনোভাবে কোনও বাধা তৈরি হয় না। চিন্তায় অকারণ পক্ষপাত আসে না। কিন্তু কোনও একটি বইকে ‘জাতীয় গ্রন্থ’ ঘোষণা করে দিলে প্রাক-বৈচারিক পক্ষপাত তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ‘এটিই সব চাইতে মূল্যবান বই’, রাষ্ট্র এমন ধারণার জন্ম দিলে কার্যত তা হয়ে দাঁড়ায় অন্য বইয়ের অবমূল্যায়ন, এমনকী অন্য বই নিষিদ্ধ করার প্রথম ধাপ।

Advertisement

যদি কোনও একটি বইয়ের মাধ্যমে সার্বধর্মিক ভারতীয় মূল্যবোধের জন্ম দেওয়াই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হয়, তা হলে সব সম্প্রদায় থেকে চিন্তাশীল মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি করা যায়, যা সকলের জন্য কিছু অবশ্যপাঠ্য নির্দিষ্ট করবে। নৈতিক, বৈজ্ঞানিক, স্বাস্থ্যকর ধারণা ও অভ্যাসের উপযোগী পাঠ যেখানে থাকবে।

এমন কোনও বিকল্পের কথা না ভেবে যে গীতাকেই বিজেপি জাতীয় গ্রন্থ করার প্রস্তাব দিল, তা অবশ্য আশ্চর্য কিছু নয়। বরং বিজেপি-র পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। তা দুটি কারণে। এক, ভারতের অধিকাংশ মানুষের কাছে গীতা নীতি এবং অধিবিদ্যার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বই। নির্বাচনী গণতন্ত্রের অতি-সরল ব্যাখ্যা বলে, যা দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে পবিত্র, তা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেও পবিত্র বলে গ্রহণ করতে হবে। এরই অন্য একটি উদাহরণ, যদি দেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করে যে প্রকাশ্যে কোনও মহিলা মাথা বা মুখ ঢাকতে পারবেন না, তা হলে মাথা-মুখ ঢাকার ধর্মীয় অনুশাসন থাকা সত্ত্বেও তিনি তা করতে পারবেন না। দুই, বিজেপি এই প্রস্তাব দিচ্ছে বিরোধীদের চিহ্নিত করতে। গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ করায় যারা আপত্তি করবে, তাদের চিহ্নিত করে প্রচার করা হবে, এরা ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’-র শত্রু।

কিন্তু এই দুটো বড়জোর বিজেপির প্রস্তাবের কারণ। প্রস্তাব কেন গ্রহণযোগ্য, তার সমর্থনে যুক্তি কোনওটাই নয়। বরং কেন এই প্রস্তাব সমর্থন করা যায় না, তার সপক্ষে জোরালো যুক্তি রয়েছে।

ইহুদি, খ্রিস্টান কিংবা শিখ ধর্মের মতো হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ-নির্ভর নয়। বছর কুড়ি আগে বিজেপি হিন্দু ধর্মকে ‘রামায়ণ-ভিত্তিক’ বলে প্রচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা যে রামায়ণকে বেছেছিল তা তুলসীদাসজি-র রামচরিতমানস, যেখানে রামকে ভগবান

বলে দেখানো হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণ অনেক প্রাচীন, কিন্তু সেখানে রাম বীর, একপত্নীক, ‘নরচন্দ্রমা’।

হিন্দু ধর্মের যে সব ‘গ্রন্থ’ পবিত্র বলে মনে করা হয়, যেগুলিকে নিয়মবিধির উৎস বলে মানা হয় (উপনিষদ, গীতা, ব্রহ্মসূত্র, যেটাকেই ধরা যাক না কেন), তার কোনওটিরই এমন কোনও সর্বসম্প্রদায়সম্মত ভাষ্য পাওয়া যায় না, যা সব হিন্দু, বা অধিকাংশ হিন্দু, গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া তো দূরের কথা। যে কোনও দার্শনিক গ্রন্থের ব্যাখ্যার একটি নির্দিষ্ট, ধারাবাহিক ঐতিহ্য রয়েছে। যেমন শঙ্করের ধারা, বা রামানুজের ধারা, মধ্ব কিংবা নিম্বার্ক কিংবা অভিনবগুপ্তের কাশ্মীরি ধারা (কাশ্মীরের ধারাতে তো গীতার পাঠও আলাদা), এবং এই ধারাগুলি একে অপরের বিরোধী। ফলে ‘গীতা নামক গ্রন্থ’ কথাটি বস্তুত একটি অর্থশূন্য শব্দ— এই জন্য নয় যে গীতা নামে কোনও গ্রন্থ নেই, কিন্তু এই জন্য যে, একটা নির্দিষ্ট মানে-যুক্ত টেক্সট হিসেবে ধরলে একাধিক গীতা রয়েছে (যার মধ্যে রয়েছে গীতার ব্যাখ্যাও)। ভেবে দেখুন, ‘ভারতীয় ভাষা’ কথাটার কোনও নির্দিষ্ট অর্থ হয় কি?

গীতা মহাভারতের একটি অংশ হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে মুদ্রিত এবং পঠিত হয়ে চলেছে। সে অর্থে সেটি নিশ্চয়ই একটি গ্রন্থ। কিন্তু কোনও গণতান্ত্রিক দেশ তার নাগরিকদের বাধ্য করতে পারে না সেটি পড়তে, বা পড়ে গর্ববোধ করতে। কোনও দেশেই তেমন কোনও একটিমাত্র বই নেই।

গীতা পড়ার প্রাকশর্ত ভাল করে সংস্কৃত শেখা। খুব খুশি হব যদি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রমে সংস্কৃতকে রাষ্ট্র একটি ‘ক্লাসিক’ ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ভাষা শিক্ষার নীতি কী হবে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ভারতের সরকার-পোষিত শিক্ষা ত্রিভাষাকে যেন পোষণ করে: সংস্কৃত, ইংরেজি এবং মাতৃভাষা। আশার কথা এটাই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নিজস্ব ওয়েবসাইট বলছে ‘একটিমাত্র গ্রন্থ: ভারতের সংবিধান’। সকলের সঙ্গে সকলের জন্য সকলের বিকাশ করতে গিয়ে মোদীজির ‘বুক কিপিং’-এ এ ভুল হতে পারে না।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন