ছবি: সুকুমার রায়
ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি, সত্তরের দশকের প্রথমার্ধ, তখনও কলকাতায় টিভি আসেনি। এক দিন পড়ায় মন বসছিল না, পড়ার টেবিলে বসে ‘আরোহী’র গল্প শুনিয়েছিল দিদি। পরে ছবিটা দেখি। বনফুলের ‘অর্জুনকাকা’ গল্প থেকে ষাটের দশকে এ ছবি করেছিলেন তপন সিংহ। পরাধীন ভারতে প্রবাসী বাঙালি জীবনের গল্প। অর্জুন গরিব, জাতে জেলে, কিন্তু একগুঁয়ে, লেখাপড়া শেখার প্রচণ্ড আগ্রহ। অর্জুন সেখানে যে ডাক্তারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লেখাপড়া শিখেছিল, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেকেই নিজের জমা টাকা দিয়ে বিলেতে উচ্চতর ডাক্তারি পড়তে পাঠায় ছবির শেষে। শেষ দৃশ্য: বিশাল জাহাজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে নবীন ডাক্তারটি, নীচে জেটিতে তার বিধবা মা, বউ, আর তার সেই অর্জুনকাকা, চেঁচিয়ে তাকে বলছে, ‘তুমি কিছু ভেবো না বাবা, তুমি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি থাকব, আমি বেঁচে থাকব, আমি নিশ্চয়ই বেঁচে থাকব।’
সেই স্কুলবেলায় স্বপ্নের মধ্যে ঘুরেফিরে আসত জাহাজের দৃশ্যটা। প্রবল ইচ্ছাশক্তির জোরে একটা মানুষ যে কী অসাধ্য সাধন করতে পারে, পড়াশোনার প্রতি ধীবর সম্প্রদায়ের এক জন মানুষের এমন একাগ্রতা অধ্যবসায়, আর পরম যত্নে সে সব লালনপালনের দায় তুলে নেন উচ্চবর্গের বাঙালি ডাক্তার। এ ছবি তপন সিংহকে চিনিয়ে দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে রেনেসাঁস হওয়া না-হওয়া নিয়ে যত তর্কই থাক, সেই সময়ের কলকাতায় আলোকপর্বের অভিঘাতে এক বিদ্বৎসমাজ তৈরি হয়েছিল, যাঁরা বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই সামাজিক রূপান্তরের পন্থা। সেই ভাবনার উত্তরাধিকার বহন করে গেছেন তপন সিংহ, আজীবন।
তপনবাবুর নানা রচনা-সাক্ষাৎকারের সঙ্কলন চলচ্চিত্র আজীবন (সম্পাদনা: শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ) বইটির এক লেখায় পড়ি: ‘আমাদের স্কুলের জ্যামিতির মাস্টারমশাই একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর জায়গায় হেডমাস্টারমশাই এলেন ক্লাস নিতে।... জ্যামিতির বদলে উনি আমাদের শোনাতে লাগলেন ‘দুই বিঘা জমি’, ‘পুরাতন ভৃত্য’ ইত্যাদি কবিতা, কথা ও কাহিনী-র প্রায় সবগুলি গল্প। সেগুলি প্রাঞ্জল করে বোঝাতে লাগলেন আমাদের। পরীক্ষার সাত দিন আগে বললেন: আমি জানি আমার ছাত্ররা খুব ভালো। বাকি চার দিনের মধ্যে জিওমেট্রির এক থেকে ষোলোর থিওরেম তারা আয়ত্ত করে ফেলুক, এটাই আমি চাই। আমরা তাই-ই করেছিলাম।... আর ওই অদ্ভুত ব্যাপারটাই আমার জীবনের ভিত তৈরি করে দিয়ে গেল।’ সাহিত্য ও বিজ্ঞানের এই অদ্ভুত সমন্বয় থেকেই নিজের উদ্ভাবনী চেতনাকে প্রকাশ করতে শিখেছিলেন তপনবাবু, আর জেনেছিলেন দেশের মানুষ কী ভাবে বাঁচে।
তাঁর কাছে তাই শিক্ষাই আত্মনির্ভরতার একমাত্র বাহন পরাধীন থেকে স্বাধীন বাঙালির দীর্ঘ জীবনচর্যায়। বলেওছেন সে কথা: ‘একটা দেশকে এগিয়ে নিতে গেলে এডুকেশন দরকার... মানুষকে নিজেকে সচেতনতা আনতে হবে, এবং তার জন্য এটুকু করতে পারে, যে কোনো একটা civilised state যেটা করে— এডুকেশন-এর ব্যবস্থা করে।’ শিক্ষা যেমন বাঙালির মেরুদণ্ডকে সিধে করবে, তেমনই তার মূল্যবোধ বা নৈতিকতাও তৈরি করবে— এই জাগ্রত বোধ থেকেই ছবি করতেন তিনি। তাঁর পরিচালক-জীবনের প্রথম পর্বে পঞ্চাশের দশকের শেষে ‘ক্ষণিকের অতিথি’, মধ্যপর্বে ষাটের দশকে ‘হাটে বাজারে’ আর সত্তরের দশকে ‘এক যে ছিল দেশ’, অন্তিম পর্বে নব্বইয়ের দশকে ‘এক ডক্টর কী মওত’ আর ‘হুইল চেয়ার’— ছবিগুলিতে একা এক ডাক্তার বা বিজ্ঞানীকে বৈষম্য আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের দরিদ্র অসহায় অশিক্ষিত রুগ্ণ ক্ষুধার্ত মানুষগুলির প্রতি সেবাপরায়ণ হয়ে উঠতে দেখি।
শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্তদেরই দায়িত্ব দেশের মানুষ তৈরি করা— এ অভিপ্রায় থেকে তাঁর ছবির চরিত্রেরা যেন নিজেদেরও তৈরি করে নেয়। আর সে প্রস্তুতি একক প্রস্তুতি। ‘আমি একক সংগ্রামে বিশ্বাস করি’, বলেছেন তপনবাবু, এক সাক্ষাৎকারে। গোষ্ঠীবদ্ধ লড়াইয়ে তাঁর কোনও দিনই আস্থা ছিল না। সে লড়াই হয়তো সহজে জেতা যায়, কিন্তু পরে মানুষে-মানুষে মনান্তরে কিংবা কলহে সে লড়াইয়ের আদর্শটাও হারিয়ে যায়। এই বিশ্বাসই প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বহু ছবিতে। সামাজিক সন্ত্রাস আর তজ্জনিত ভয়ের বিরুদ্ধে এক শিক্ষকের রুখে দাঁড়ানো: ‘আতঙ্ক’ বা ‘অন্তর্ধান’। শ্রমজীবী মানুষের একক লড়াই: ‘সাগিনা মাহাতো’, ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘আদমি অওর অওরত’। ‘আদালত ও একটি মেয়ে’র ধর্ষিত তরুণী শিক্ষিকা তার স্কুলে বয়ঃসন্ধির বালিকাদের পড়ানোর মধ্যেই নিজের মুক্তি খুঁজে নেয়, প্রতিকূল সমাজের মুখে কুলুপ এঁটে দেয়। ‘হারমোনিয়ম’-এ নিঃস্ব বিধবা জমিদারকন্যা বিমলা নিজের পায়ের তলায় জমি খুঁজে পায় একটি বাচ্চা মেয়েকে আশ্চর্য এক গান শেখাতে শেখাতে: ‘মন বলে আমি মনের কথা জানি না/ তারায় তারায় উড়ে বেড়ায়/ মাটিতে সে নামে না।’
‘গল্প হলেও সত্যি’তে ধনঞ্জয়ও বালক পিন্টুকে একটা গান শিখিয়েছিল: ‘শুক বলে ওঠো শারি ঘুমায়ো না আর,/ এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার।’ ওই অশান্তির পরিবারে প্রায় শিক্ষক হয়ে উঠেছিল ধনঞ্জয়। ভোর ছ’টা বাজলে বলত, ‘কাজ করবার এই তো হচ্ছে সবচেয়ে ভাল সময়’, আরও বলত, ‘কাজ মানেই মুক্তি, মুক্তি মানেই কাজ।’ তার কাছে শিখেই পরিবারের সদস্যরা কাজে মন দিয়েছিল। বড় আর মেজ, দুই প্রবীণ ভাইই বলতে শুরু করল: ‘কাজ করা যাক... ভালভাবে কাজ করতে হবে, বাঁচতে হবে।’ তরুণ সদস্যটি বলল, ‘পরিশ্রম যদি না করো, পরিশ্রম করার ক্ষমতা একেবারে চলে যায়।’ এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার, এ নিয়ে বড় আফশোস ছিল তপন সিংহের, বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার বা কর্মকাণ্ডকে কতটুকুই বা আয়ত্তে আনতে পারে মানুষ একটা জীবনে। ‘আরোহী’ করার সময় তাঁর উপলব্ধি: ‘জ্ঞানের পরিধি এত বিস্তৃত, যার কাছে জীবন খুবই ছোটো।’ আর তাই ‘হাটে বাজারে’র ডাক্তারটি পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত দেখে ভাবতেন, ‘দিন শেষ হয়ে গেল, কোনও কাজই তো করা হল না।’